রাসলুল্লাহ (সঃ) এর জীবনের সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত নিয়ে "সাল্লি আলা মুহাম্মাদ"

রাসলুল্লাহ (সঃ) এর জীবনের সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত নিয়ে "সাল্লি আলা মুহাম্মাদ"

রাসলুল্লাহ (সঃ) এর জীবনের সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত নিয়ে "সাল্লি আলা মুহাম্মাদ"


- বুকস ইয়ার্ড- Tuhfa Jannat Tuaha



সুপ্রিয় মেম্বারগণ! আসসালামু আলাইকুম।আপনারা ইতিমধ্যে অবগত হয়েছেন যে পবিত্র মাহে রমজান উপলক্ষ্যে বুকস ইয়ার্ড বেশ কয়েকটি সেগমেন্টের আয়োজন করেছে। রাসলুল্লাহ (সঃ) এর জীবনের সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত নিয়ে আমাদের সেগমেন্ট "সাল্লি আলা মুহাম্মাদ"।


আজকের টপিকঃ নবিজীর শৈশব ও কৈশোরকাল

বনি সা'দ গোত্রে অবস্থানঃ
তৎকালীন আরবের রীতি ছিল যে তারা মরুভূমির মুক্ত আবহাওয়ায় বেড়ে উঠার মাধ্যমে সন্তানদের সুস্থ দেহ এবং সুঠাম গড়ন তৈরির জন্য জন্মের পরপরই দুধ পান করানোর কাজে নিয়োজিত বেদুইন মহিলাদের কাছে দিয়ে দিতেন এবং নির্দিষ্ট সময় পর আবার ফেরত নিতেন। এর আরেকটি কারণ ছিল বিশুদ্ধ আরবি ভাষা শিক্ষা করা। এই রীতি অনুসারে মোহাম্মদকেও হালিমা বিনতে আবু জুয়াইবের (অপর নাম হালিমা সাদিয়া) হাতে দিয়ে দেয়া হয়। এই নারী ছিলেন বনু সা'দ ইবনে বকর গোত্রের (হাওয়াযেন গোত্র) অন্তর্ভুক্ত। তার স্বামীর নাম ছিলো হারেস ইবনে আবদুল ওযযা আর ডাক নাম আবু কাবশা, যিনি একই গোত্রের লোক ছিলেন।

মোহাম্মদ (সাঃ) এতিম বিধায় প্রথমে কোন নারী তাকে দুধ খাওয়ানোর জন্য নিতে চায়নি। কিন্তু হালিমা অন্য কোন শিশু সন্তান না পাওয়ায় এই এতিম শিশুটিকেই গ্রহণ করেন। কিন্তু এই শিশুকে ঘরে আনার পর দেখা যায় হালিমার সচ্ছলতা ফিরে আসে এবং তারা শিশুপুত্রকে সঠিকভাবে লালনপালন করতে সমর্থ হন। তখনকার একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য - শিশু মোহাম্মদ কেবল হালিমার একটি স্তনই পান করতেন এবং অপরটি তার অপর দুধভাইয়ের জন্য রেখে দিতেন।

দুই বছর লালনপালনের পর হালিমা শিশু মোহাম্মদকে আমিনার কাছে ফিরিয়ে দেন। কিন্তু এর পরপরই মক্কায় মহামারী দেখা দেয় এবং শিশু মুহাম্মদকে হালিমার কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। হালিমাও চাচ্ছিলেন শিশুটিকে ফিরে পেতে। এতে তার আশা পূর্ণ হল।

এর কয়েকদিন পরই একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটে - একদিন শিশু নবীর বুক চিরে কলিজার একটি অংশ বের করে তা জমজম কূপেরপানিতে ধুয়ে আবার যথাস্থানে স্থাপন করে দেয়া হয়। মুসলমানদের বিশ্বস্ত হাদিস গ্রন্থ মুসলিম শরীফেরবর্ণনসূত্রে এই তথ্য পাওয়া যায়। মুসলমানদের বিশ্বাসমতে এর মাধ্যমে মুহাম্মদের দেহ থেকে অপবিত্র সব কিছু ধুয়ে ফেলা হয়েছিল।

ইবনে খালদুনেরবর্ণনামতে তার অন্তরে নূর ভরে দেয়া হয়। এই ঘটনাটি কারণেই গুরুত্বপূর্ণ যে এতে ইসলামে অলৌকিকতার স্বরুপ বুঝা যায়। ঘটনাটি ফেরেশতাদের দ্বারা সম্পন্ন হয় এবং এই ফেরেশতা হলেন জীবরাইল। এই ঘটনাটি ইসলামের ইতিহাসে সিনা চাকের ঘটনা হিসেবে খ্যাত।

মাতৃবিয়োগঃ

এই ঘটনার পরই হালিমা মুহাম্মদকে মা আমিনার কাছে ফিরিয়ে দেন। ছয় বছর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত তিনি মায়ের সাথে কাটান। এই সময় একদিন আমিনার ইচ্ছা হয় ছেলেকে নিয়ে মদীনায় যাবেন। সম্ভবত কোন আত্মীয়ের সাথে দেখা করা এবং স্বামীর কবর জিয়ারত করাই এর কারণ ছিল। আমিনা ছেলে, শ্বশুর এবং দাসী উম্মে আয়মনকে নিয়ে ৫০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মদীনায় পৌঁছেন। তিনি মদীনায় একমাস সময় অতিবাহিত করেন। একমাস পর মক্কায় ফেরার পথে আরওয়া নামক স্থানে এসে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।

দাদার মৃত্যুঃ

মাতার মৃত্যুর পর দাদা আবদুল মোত্তালেব শিশু মুহাম্মদকে নিয়ে মক্কায় পৌঁছেন। এর পর থেকে দাদাই মুহাম্মদের দেখাশোনা করতে থাকেন। তিনি শিশু নবীকে নিজের সন্তানদের থেকেও অধিক ভালবাসতেন। ইবনে হিশাম তার সীরাত গ্রন্থে লিখেছেন "আবদুল মোত্তালেবের জন্য কাবাঘরের ছায়ায় বিছানা পেতে দেয়া হতো। তার সব সন্তান সেই বিছানার চারদিকে বসতো। কিন্তু মোহাম্মদ গেলে বিছানায়ই বসতেন। বালক মোহাম্মদের কাজকর্ম তাকে আনন্দ দিতো।" মোহাম্মদের বয়স যখন ৮ বছর ২ মাস ১০ দিন তখন তার দাদাও মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি তার পুত্র আবু তালিবকে মোহাম্মদের দায়িত্ব দিয়ে যান।

সিরিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রাঃ

আবু তালিবের বাড়িতে মুহাম্মদ বেড়ে উঠতে থাকেন। চাচা তাকে অসম্ভব আদর করতেন এবং মুহাম্মদও চাচাকে বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করতেন। যেমন তিনি অন্যান্য বালকদের মতই মাঠে আবু তালিবের ছাগল চড়াতেন। কিন্তু এ সময় থেকেই তাকে চিন্তাশীল মনে হত।

আবু তালিব ব্যবসায়ী ছিলেন এবং আরবদের নিয়ম অনুযায়ী বছরে একবার সিরিয়া সফরে যেতেন। মুহাম্মদের বয়স যখন ১২ ব্ছর তখন তিনি চাচার সাথে সিরিয়া যাওয়ার জন্য বায়না ধরলেন। প্রগাঢ় মমতার কারণে আবু তালিব আর নিষেধ করতে পারলেননা। যাত্রাপথে বসরা পৌঁছার পর কাফেলাসহ আবু তালিব তাঁবু ফেললেন।

সে সময় আরব উপদ্বীপের রোম অধিকৃত রাজ্যের রাজধানী বসরা অনেক দিক দিয়ে সেরা ছিল। কথিত আছে, শহরটিতে জারজিস সামে এক খ্রিস্টান পাদ্রী ছিলেন যিনি বুহাইরা বা বহিরা নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি তার গির্জা হতে বাইরে এসে কাফেলার মুসাফিরদের মেহমানদারী করেন। এ সময় তিনি বালক মুহাম্মদকে দেখে শেষ নবী হিসেবে চিহ্নিত করেন। কারণ তিনি তার অন্তর দৃষ্টি দিয়ে লক্ষ্য করেন যে সব গাছপালা, পাথর এই বালকটিকে সেজদা করছে।

তিনি বর্ননা করেন, "এতো সেই সাইয়েদুল মুরসালীন, অতীতের সমস্ত নবী যার আগমন সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করে গেছেন।" তিনি আবু তালিবকে মুহাম্মদকে সিরিয়ায় নিয়ে যেতে নিষেধ করেন; কারণ সেখানকার ইহুদীরা তার ক্ষতি করতে পারে। পাদ্রীর কথা শুনে মুহাম্মদকে কয়েকজন ভৃত্যের মাধ্যমে মক্কায় পাঠিয়ে দেয়া হয়।

ফুজ্জারের যুদ্ধঃ
ফুজ্জারের যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন নবীর বয়স ১৫ বছর। এই যুদ্ধে তিনি স্বয়ং অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের নির্মমতায় তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হন। কিন্তু তাঁর কিছু করার ছিলনা। সে সময় থেকেই তিনি কিছু একটি করার চিন্তাভাবনা শুরু করেন।




সুপ্রিয় মেম্বরগণ!
আসসালামু আলাইকুম।
পবিত্র মাহে রমজান উপলক্ষ্যে বুকস ইয়ার্ড বেশ কয়েকটি সেগমেন্টের আয়োজন করেছে। রাসলুল্লাহ (সঃ) এর জীবনের সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত নিয়ে আমাদের সেগমেন্ট "সাল্লি আলা মুহাম্মাদ"।
আজকের টপিকঃ ওহীর সংক্ষিপ্ত বর্ননা, দাওয়াত ও রিসালাত।
ওহীর বর্ননাঃ
রিসালাত ও নবুওয়্যাতের বরকতময় বিষয়াদির বিস্তৃত বিবরণ লিপিবদ্ধ করার পূর্বে ওহীর প্রকৃতি ও প্রকারভেদ সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করার প্রয়োজন বোধ করছি। কারণ, এটাই হচ্ছে রেসালাতের উৎস এবং প্রচারের উপায়। ওহীর প্রকৃতি এবং প্রকারভেদ সম্পর্কে আল্লামা ইবনে কাইয়্যিম যে আলোচনা করেছেন তা নিম্নে লিপিবদ্ধ করা হলঃ
১. সত্য স্বপ্নঃ স্বপ্নের মাধ্যমে নবী কারীম (সাঃ)-এর উপর ওহী অবতীর্ণ হয়।
২. ফেররেশতা দেখা না দিয়ে অর্থাৎ অদৃশ্য অবস্থান থেকেই রাসূল (সাঃ)-এর অন্তরে ওহী প্রবেশ করিয়ে দেন।
৩. ফেরেশতা মানুষের আকৃতি ধারণপূর্বক নবী কারীম (সাঃ)-কে সম্বোধন করতেন। তারপর তিনি যা কিছু বলতেন নবী কারীম (সাঃ) তা মুখস্থ করে নিতেন। এ অবস্থায় সাহাবীগণ (রাঃ)ও ফেরেশতাকে দেখতে পেতেন।
৪. ওহী অবতীর্ণ হওয়ার সময় নাবী কারীম (সাঃ)-এর নিকট ঘন্টার টুনটুন ধ্বনির মতো ধ্বনি শোনা যেত। ওহী নাযিলের এটাই ছিল সব চাইতে কঠিন অবস্থা। টুন টুন ধ্বনির সংকেত প্রকাশ করতে করতে ফিরিশতা ওহী নিয়ে আগমন করতেন এবং নাবী (সাঃ)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। ওহী নাযিলের সময় কঠিন শীতের দিনেও রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কপাল থেকে ঘাম ঝরতে থাকত। তিনি উষ্ট্রের উপর আরোহণরত অবস্থায় থাকলে উট বসে পড়ত। এক দফা এইভাবে ওহী নাযিল হওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উরু যায়দ বিন সাবেত (সাঃ)-এর উরুর উপর ছিল। তখন তাঁর উরুতে এতই ভারবোধ হয়েছিল যে মনে হয়েছিল যেন উরু চূর্ণ হয়ে যাবে।
৫. নাবী কারীম (সাঃ) ফিরিশতাকে কোন কোন সময় নিজস্ব জন্মগত আকৃতিতে প্রত্যক্ষ করতেন এবং আল্লাহর ইচ্ছায় সেই অবস্থাতেই তিনি তাঁর নিকট ওহী নিয়ে আগমন করতেন। নাবী কারীম (সাঃ)-এর এ রকম অবস্থা দু’বার সংঘটিত হয়েছিল যা আল্লাহ তা‘আলা সূরাহ ‘নাজমে’ উল্লে­খ করেছেন।
৬. পবিত্র মি’রাজ রজনীতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন আকাশের উপর অবস্থান করছিলেন সেই সময় আল্লাহ তা‘আলা নামায এবং অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে সরাসরি হুকুমের মাধ্যমে ওহীর ব্যবস্থা করেছিলেন।
৭. আল্লাহ তা‘আলার সঙ্গে নাবী কারীম (সাঃ)-এর সরাসরি কথোপকথন যেমনটি হয়েছিল, তেমনি মূসা (আঃ)-এর সঙ্গে হয়েছিল। মূসা (আঃ)-এর সঙ্গে যে আল্লাহ তা‘আলার কথোপকথন হয়েছিল কুরআন কারীমে তা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার সঙ্গে নাবী কারীম (সাঃ)-এর কথোপকথনের ব্যাপারটি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে।
কোন কোন লোক পর্দা বা আবরণ ব্যতিরেকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সাঃ)-এর সামনা-সামনি কথোপকথনের মাধ্যমে ওহী নাযিলের অষ্টম রীতির কথা বলেছেন।
নবুওয়্যাতের ধারাবাহিকতাঃ
আলোচনা ও অনুধাবনের সুবিধার্থে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পয়গম্বরী জীবন কালকে দুইটি অংশে বিভক্ত করে নিয়ে আলোচনা করা হয়। কাজকর্মের ধারা প্রক্রিয়া এবং সাফল্য। সাফল্যের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করলে দেখা যাবে যে এর এক অংশ থেকে ছিল ভিন্নধর্মী এবং ভিন্নতর বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যময়। অংশ দুটি হচ্ছে যথাক্রমেঃ
১. মক্কায় অবস্থান কাল প্রায় তের বছর
২. মদীনায় অবস্থান কাল দশ বছর
তারপর মক্কী ও মাদানী উভয় জীবনকাল বৈশিষ্ট্য ও কর্ম প্রক্রিয়ার ব্যাপারে ছিল স্তর ক্রমিক এবং ভিন্নধর্মী। তাঁর পয়গম্বরী জীবনের উভয় অংশ পর্যালোচনা এবং পরীক্ষণ করলে অনুক্রমিক স্তরগুলো সমীক্ষা করে দেখা বহুলাংশে সহজতর হয়ে উঠবে।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মক্কাবস্থান কাল এবং কর্মপ্রক্রিয়াকে তিনটি আনুক্রমিক স্তরে বিভক্ত করে নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। সেগুলো হচ্ছে:
১. সর্ব সাধারণের অবগতির অন্তরালে গোপন দাওয়াতী কর্মকান্ডের স্তর (তিন বছর)।
২. মক্কাবাসীগণের নিকট প্রকাশ্য দাওয়াত ও তাবলীগী কাজের স্তর (৪র্থ বছর থেকে ১০ম বছরের শেষ নাগাদ)।

৩. মক্কার বাইরে ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ ও বিস্তৃতির স্তর (১০ম নুবুওয়াতী বর্ষের শেষ ভাগ হতে হিজরত পর্যন্ত)।
Next Post Previous Post