রাত্রির কিছু অংশ কোরআন পাঠ সহ জাগ্রত থাকুন: সুরা বনী-ইসরাঈল ১৭:৭৯
রাত্রির কিছু অংশ কোরআন পাঠ সহ জাগ্রত থাকুন। এটা আপনার জন্যে অতিরিক্ত। হয়ত বা আপনার পালনকর্তা আপনাকে মোকামে মাহমুদে পৌঁছাবেন। [ সুরা বনী-ইসরাঈল ১৭:৭৯ ]
সুলতান নুরুদ্দিন জেংগি। দুর্যোগকালের মহানায়ক।
নুরুদ্দিন বাস করতেন দামেশকে। এই শহরের প্রেমে পড়েছিলেন তিনি। কিন্তু জিহাদের প্রেম তাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল শহরের সৌন্দর্য, খেজুর বাগানে বয়ে চলা বাতাস আর নহরের কলতান। ঐতিহাসিক ইমাদুদ্দিন ইসফাহানী লিখেছেন, একবার আমরা দামেস্কে অবস্থান করছিলাম। সময়টা ছিল সফর মাস। পরিচ্ছন্ন আবহাওয়া। একদিন আমরা নুরুদ্দিন জেংগির পাশে বসা ছিলাম। কথায় কথায় আমরা দামেস্কের প্রশংসা করতে থাকি। দামেস্কের সুরম্য প্রাসাদ, মনোরম উদ্যান,এখানের শীতল আবহাওয়ার কথা উঠে আসে। তখন নুরুদ্দিন জেংগি বললেন,জিহাদের ভালোবাসা আমাকে এসব ভুলিয়ে দিয়েছে। এখন এসবে আমার কোনো আগ্রহ নেই।
একজন শাসক। একজন যোদ্ধা। একজন সেনাপতি। সবক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সফল। ইবনে আসির লিখেছেন, আমি শাসকদের জীবনি পড়েছি। উমার ইবনে আবদুল আজিজের পর নুরুদ্দিনের মত আর কোনো মহান শাসক দেখিনি।
সুলতান নুরুদ্দিন রাতে দীর্ঘসময় তাহাজ্জুদ পড়তেন। দিনে জিহাদ করতেন কিন্তু আত্মিক শক্তি ও আল্লাহর সাহায্য চেয়ে নিতেন রাতের বেলাতেই। একদল সুফি গেলেন বাইতুল মাকদিসে। সেখানের খ্রিস্টানরা তাদেরকে বললো, ইমাদুদ্দিনের ছেলের সাথে আল্লাহর একটা গোপন সম্পর্ক আছে। সে তাঁর সেনাবাহিনী ও অস্ত্রের শক্তিতে আমাদের সাথে বিজয় লাভ করে না, বরং সে রাতের সালাত ও দোয়া দিয়ে আমাদের পরাস্ত করে। সে রাতের আল্লাহর কাছে হাত তুলে দোয়া করে। আর দিনের বেলা সে আমাদের সাথে জিতে যায়। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)
নুরুদ্দিনের স্ত্রী ইসমাতুদ্দিনও ছিলেন স্বামীর মত নেককার। তিনিও রাতে দীর্ঘসময় তাহাজ্জুদ পড়তেন। কখনো ঘুম থেকে উঠতে না পারলে পেরেশান হয়ে যেতেন।
২
শেষরাত বড় অদ্ভুত সময়। নির্জন হয়ে আসে চারিদিক। পৃথিবীর সকল ব্যস্ততা আর প্রয়োজন তখন বিরতিতে। বন্ধ হয়ে গেছে পৃথিবীর সব দুয়ার। আমাদের প্রয়োজন শোনার জন্য প্রস্তুত নয় কেউ। আর সে সময় রব অপেক্ষা করছেন কেউ তার কাছে ক্ষমা চাইবে, দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যান চাবে। তিনি অপেক্ষা করেন, কেউ কিছু চাইলে তাকে তা দান করার জন্য। পৃথিবীর মানুষদের সব ঘৃণা-অবহেলা-অপবাদে বিপর্যস্ত বান্দার জন্য তিনি নিজের দুয়ার খোলা রাখেন। দরজা খোলা থাকে তাদের জন্য, যারা চলে গেছে বিপদে। বন্ধু বানিয়েছে শয়তান ও তার অনুসারীদেরকে। ডুবে গেছে পাপাচারে। নিজের পাপরাশির দিকে তাকিয়ে তারও হতাশ হবার কিছু নাই। রব তার জন্য অপেক্ষা করছেন। তার তওবা কবুল করার জন্য রব প্রস্তুত আছেন।
৩
মানসুর বিন মুতামির নিজ বাড়ির ছাদে কিয়ামুল লাইল আদায় করতেন। তার মৃত্যুর পর প্রতিবেশির ছেলে তার মাকে জিজ্ঞেস করলো, আম্মু, আমাদের পাশের ছাদে রাতের বেলা একটা খুঁটি দেখা যেত। এখন দেখি না কেন? মা বললেন, বাবা, এটা খুঁটি নয়। রাতের বেলা এখানে মানসুর বিন মুতামির কিয়ামুল লাইল আদায় করতেন। এখন তিনি মারা গেছেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৫/৪০৬)
আইয়ুব সখতিয়ানি সারা রাত ইবাদত করতেন। কিন্তু তিনি চাইতেন কেউ তা না জানুক। তাই ভোরে তিনি কন্ঠ উঁচু করতেন, যেন লোকে ভাবে তিনি এইমাত্র ঘুম থেকে উঠেছেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৬/১৫)
হাসান বিন সালিহ রাতকে তিন ভাগে ভাগ করেছিলেন। এক ভাগে তিনি ইবাদত করতেন। অন্যভাগে তার মা, আরেক ভাগে তার ভাই। তার মায়ের ইন্তেকালের পর তিনি ও তার ভাই রাতকে দুইভাগে ভাগ করেন। ভাইয়ের মৃত্যুর পর তিনি একাই সারা রাত জেগে থাকতেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৭/৩৬১)
সাইদ বিন আবদুল আযিয সারা রাত জেগে ইবাদত করতেন। ফজরের সময় হলে নতুন করে অজু করে মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হতেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৮/৩২)
৪
রাতের ইবাদতে থাকে একনিষ্ঠতা। কাউকে দেখানোর সুযোগ নেই, ফলে রিয়া আসার সম্ভাবনাও যায় কমে। এই ইবাদত তার আত্মিক শক্তিকে দৃঢ় করে। তাকে দেয় জনতার মাঝে নির্জনতা অনুভবের সামর্থ্য।
আল্লাহ তাআলা নানাভাবে বান্দাদেরকে কিয়ামুল লাইলের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন
تَتَجَافَى جُنُوبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَطَمَعًا وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ
তাদের পার্শ্ব শয্যা থেকে আলাদা থাকে। তারা তাদের পালনকর্তাকে ডাকে ভয়ে ও আশায় এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে। [ সুরা সাজদা ৩২:১৬ ]
وَعِبَادُ الرَّحْمَنِ الَّذِينَ يَمْشُونَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْنًا وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلَامًا وَالَّذِينَ يَبِيتُونَ لِرَبِّهِمْ سُجَّدًا وَقِيَامًا
রহমান-এর বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদের সাথে যখন মুর্খরা কথা বলতে থাকে, তখন তারা বলে, সালাম। এবং যারা রাত্রি যাপন করে পালনকর্তার উদ্দেশ্যে সেজদাবনত হয়ে ও দন্ডায়মান হয়ে; [ সুরা ফুরকান ২৫:৬৩, ৬৪ ]
রহমান-এর বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদের সাথে যখন মুর্খরা কথা বলতে থাকে, তখন তারা বলে, সালাম। এবং যারা রাত্রি যাপন করে পালনকর্তার উদ্দেশ্যে সেজদাবনত হয়ে ও দন্ডায়মান হয়ে; [ সুরা ফুরকান ২৫:৬৩, ৬৪ ]
وَمِنَ اللَّيْلِ فَتَهَجَّدْ بِهِ نَافِلَةً لَّكَ عَسَى أَن يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَّحْمُودًا
রাত্রির কিছু অংশ কোরআন পাঠ সহ জাগ্রত থাকুন। এটা আপনার জন্যে অতিরিক্ত। হয়ত বা আপনার পালনকর্তা আপনাকে মোকামে মাহমুদে পৌঁছাবেন। [ সুরা বনী-ইসরাঈল ১৭:৭৯ ]
আল্লাহ আমাদেরকে রাতের এবাদতের তাওফিক দিন। সালাতকে আমাদের চোখের প্রশান্তি বানান।
#নির্মল_জীবন