কবি আবদুল কাদির | কবির জীবনী | কবি আবদুল কাদির জীবনী ও কবিতা

 কবি আবদুল কাদির -  কবির জীবনী |  কবি আবদুল কাদির এর কবিতা


কবি আবদুল কাদির | কবির জীবনী |  কবি আবদুল কাদির এর কবিতা





কবি আবদুল কাদির জন্মদিনের আলোচনা


১.
স্বনামধন্য কবি, প্রাবন্ধিক, ছন্দোবিশারদ, সম্পাদক আবদুল কাদির। ১৯০৬ সালের ১ জুন কুমিল্লা জেলার আড়াইসিধা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। জন্মদিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, ১৯৮৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর ঢাকায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আবদুল কাদির মূলধারার সাহিত্য ও সাহিত্য আন্দোলনে যৌবনের প্রারম্ভেই নিজেকে যুক্ত করতে পেরেছিলেন। ১৯২৬ সালে ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজের ‘শিখা গোষ্ঠী’র নেতৃত্বে যে ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলন সূচিত হয়- কবি আবদুল কাদির ছিলেন সেটির নেতৃস্থানীয় উদ্যোক্তা।


 ‘শিখা গোষ্ঠী’র মর্মবাণী ছিল ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট মুক্তি সেখানে অসম্ভব’। তিনি ছিলেন সাহিত্য সমাজের মুখপত্র বার্ষিক ‘শিখা’ (১৯২৭) পত্রিকার লেখক ও প্রকাশক। কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী নজরুল ইসলামসহ ওই সময়ের শীর্ষস্থানীয় লেখকদের সাহচর্য ও সান্নিধ্য লাভ করে নিজেকে অগ্রসর করার প্রয়াস পান তিনি। ছন্দ সমীক্ষণ (১৯৭৯) নামে তার একটি বিখ্যাত বই রয়েছে। যাতে তিনি বাংলা ছন্দ সম্পর্কে মৌলিক বক্তব্য রেখেছেন। তার ছন্দ বিচারের ক্ষমতা ছিলো অতুলনীয়। আবদুল কাদির নানাভাবে কর্মযোগের স্বাক্ষর রেখেছেন। একক বৃত্তে নয়, নানা বৃত্তে নিজেকে মেলে ধরেছেন। শেষাবধি তিনি লেখালেখি করতে চেয়েছেন এবং তাতেই প্রতীতি রেখেছেন। ফলে আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে আবিষ্কার করি, তার বহুধা বিভক্ত কাজের উৎকর্ষতা। সাহিত্য সম্পাদক হিসেবেও তিনি পরিশ্রমী এবং একনিষ্ঠতার ছাপ রেখেছেন।


২.
আবদুল কাদিরের কবি খ্যাতি বর্তমানে যেমনভাবে চাপা পড়ে আছে, তেমনি তার নিরলস গবেষণা ও সাহিত্যকর্মও খুব একটা আলোচিত ও মূল্যায়িত হচ্ছে না। বিষয়টি আমাকে ভীষণভাবেই ভাবায়, সমকালকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে। যার কারণে ডানা বিস্তার করতে পারছে না সুস্থ সাহিত্য সমালোচনা। বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী কবি আবদুল কাদির প্রধানত সনেট ফর্মকেই কবিতার বাহন হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। সনেট বিশ্লেষণে আবদুল কাদির বিশুদ্ধতার রীতির ব্যাপারে ছিলেন আপোসহীন। তিনি নিজেও সনেট রচয়িতার ক্ষেত্রে শুদ্ধতার আশ্রয় গ্রহণ করতেন। 


সমালোচকদের মতে তার সনেট বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল। ছন্দ নিয়ে গবেষণা করে যারা খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করেছিলেন আবদুল কাদির তাদের একজন। মাহবুবুল হক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থে আবদুল কাদির সম্পর্কে বলেন- 'তার কাব্যপ্রয়াসে মোহিতলাল মজুমদারের ধ্রুপদী সংগঠন নজরুলের উদাত্ত আবেগের চমৎকার সমন্বয় সহজেই লক্ষণীয়।' (পৃ-৭২৬)। কবি গবেষক খালেদ হোসাইন তার 'বাংলা কবিতার ছন্দ' প্রবন্ধে আবদুল কাদির সম্পর্কে বলেন- 'আবদুল কাদির তিরিশি কবিদের সমকালে কবিতা লিখেছেন। কবি হিসেবে রোমান্টিক। তার প্রেমিকা দিলরুবা যেন নভোলোকের বাসিন্দা। এক ধরনের শুদ্ধবাদিতা আছে কবিতায়। মাত্রাতিরিক্ত ছন্দপ্রবণ। ছন্দ বিষয়ে রক্ষণশীল।' (বাংলা ছন্দের মানচিত্র -সম্পাদনা: ড. খালেদ হোসাইন ও মুজিবুল হক কবীর, অনিন্দ প্রকাশন, পৃ-৩৯২)


৩.
আবদুল কাদির ছাত্র হিসেবে ছিলেন ভীষণ মেধাবী, এসএসসি পরীক্ষায় পাঁচটি বিষয়ে লেটারসহ উত্তীর্ণ হন। অথচ তার পক্ষে উচ্চশিক্ষা তথা উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণ করা হয়ে ওঠেনি। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে আই-এস-সি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্ক, অর্থনীতি, ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে বিএ পড়তে থাকেন। কিন্তু বিএতে ভর্তি হয়ে কিছুদিন অধ্যয়নই করেন, পড়াশোনা নিয়মিত রাখা, সময় অনুযায়ী পরীক্ষা দেয়া তার পক্ষে আর সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। কারণ, কাব্যচর্চা ও পত্র-পত্রিকা প্রকাশনায় তিনি সম্পূর্ণরূপে মনোযোগী হয়ে ওঠেন। এ ব্যাপারটি একেবার সরলীকরণ না করে যদি দেখি একটু খতিয়ে, তাহলে কাদিরের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও গন্তব্যমুখ হবে ধোঁয়াশামুক্ত ও স্পষ্ট। লেখালেখির ভুবনই যে তার অভীষ্ট ক্ষেত্র সেটা তখন শুধু প্রকাশিত হয়নি, দৃঢ়ভাবেই আওয়াজ দিয়েছে আগমন বার্তার। কাদির ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রাবস্থাতেই যুক্ত হয়েছেন, মুসলিম সাহিত্য সমাজের সঙ্গে। এ গোষ্ঠীর সবেচেয়ে অনুজ সদস্য হয়েও তিনি পালন করেছেন অগ্রজ সমতুল ভূমিকা। মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপত্র শিখা’র ছিলেন লেখক-প্রকাশক। শিখা গোষ্ঠীর সান্নিধ্যে এসেই তিনি নির্বাচন করতে সমর্থ হয়েছিলেন তার আগামীর গন্তব্য। ফলে আড়াল বা বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে শ্রেণিকক্ষের পাঠগ্রহণ ও প্রস্তুতি। কাদিরের লেখক সত্তা-সম্পাদক স্বরূপ এবং সংগ্রাহকের শ্রম-কৌশল ও ধীশক্তি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি তারুণ্যের প্রারম্ভেই স্থির করতে পেরেছিলেন নিজের স্বপ্ন ও করণীয়। এ কারণে একাডেমিক পাঠকে তিনি একপ্রকার ছুটি দিয়ে উৎসর্গীকৃত হয়েছিলেন লেখালেখি ও সম্পাদকীয়তার যুদ্ধে।



৪.
আবদুল কাদিরের ( জন্ম : ১ জুন, ১৯০৬ – মৃত্যু : ডিসেম্বর, ১৯৮৪) পিতা হাজী আফসারউদ্দীন ছিলেন একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। শৈশবে মাতৃহারা হওয়ার কারণে পিতার তত্ত্বাবধানেই তিনি বড় হন। তিনি ১৯২৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া অন্নদা মডেল হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯২৫ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিএ শ্রেণিতে অধ্যয়ন করেন। ১৯৩৫ সালে তিনি কমরেড মুজফ্‌ফর আহমদের মেয়ে আফিয়া খাতুনকে বিয়ে করেন।


৫.
আবদুল কাদিরের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দিলরুবা’ বের হয় পরিণত বয়সে ১৯৩৩ সালে। ‘দিলরুবা’ তাকে বিপুল কবি পরিচিতি ও প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। দিলরুবার প্রায় ৩৪ বছর পর বের হয় তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'উত্তর বসন্ত'। মহৎ মনীষা চর্চায় ব্যাপৃত হওয়ার আগেই আমরা দেখি আবদুল কাদিরের সৃজনচর্চার উন্মেষ ঘটেছে। এবং শুধু উন্মেষ নয় সেখানেও তিনি সমীহ ও স্বাতন্ত্রিকতার নজির রাখতে হয়েছেন সমর্থ। আবদুল কাদিরের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দিলরুবা’ প্রকাশিত হয় ১৩৪০ বঙ্গাব্দে। এ কাব্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অভিমত হলো, “তোমার ‘দিলরুবা’ বইখানি পড়ে খুশী হলুম। ভাষা এবং ছন্দে তোমার প্রভাব অপ্রতিহত। তোমার বলিষ্ঠ লেখনীর গতিবেগ কোথাও ক্লান্ত হয় না। বাংলার কবি সভায় তোমার আসনের অধিকার অসংশয়িত। বিষয় অনুসারে যে কবিতায় তুমি মাঝে মাঝে আরবী পারসী শব্দ ব্যবহার করেছ আমার কানে তা অসঙ্গত বোধ হয়নি।” রবীন্দ্রনাথের সপ্রশংস মন্তব্য, সাধুবাদ ও অভিনন্দন বাণীর পাশাপাশি পেয়েছেন মোহিতলাল মজুমদারের সূক্ষ্ম সমালোচনা ও সতর্ক অভিনন্দন



৬.
আবদুল কাদির ১৯২৯ সালে কলকাতার মাসিক সওগাত পত্রিকার সম্পাদনা বিভাগে যোগদান করেন। 

আবদুল কাদির কিছুকাল (১৯৩০-১৯৪৬) কলকাতা কর্পোরেশনের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। তার পাশাপাশি তিনি মাসিক জয়তী পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ (১৯৩০-১৯৩৩) করেন। এ ছাড়া সাপ্তাহিক নবশক্তি (১৯৩৪), যুগান্তর (১৯৩৮), দৈনিক নবযুগ (১৯৪১), ভারত সরকারের প্রচার বিভাগের সাপ্তাহিক মুখপত্র বাংলার কথা, সাপ্তাহিক মোহাম্মদী (১৯৪৬) এবং সাপ্তাহিক পয়গম (১৯৪৭-১৯৫২) পত্রিকায়ও তিনি বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫২ সালে ঢাকায় এসে তিনি মাসিক মাহে নও পত্রিকা সম্পাদনা করেন (১৯৫২-১৯৬৪)। পরবর্তীকালে তিনি কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের প্রকাশনা কর্মকর্তা (১৯৬৪-১৯৭০) পদে দায়িত্ব পালন করেন।


৭.
আবদুল কাদির সম্পাদিত ‘জয়তী’ সম্পর্কে আবুল ফজল লিখেছেন, “বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার মুখপত্র ‘কল্লোল’ বেরিয়েছিল ১৩৩০-এর বৈশাখে আর বেঁচে ছিল সাত বছর। ‘জয়তী’ বের হলো বৈশাখ ১৩৩৭ থেকে অর্থাৎ ‘কল্লোল’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই। কাজেই ‘কল্লোল’-এর কিছুটা সুর ‘জয়তী’তেও প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। এমনকি কল্লোল গোষ্ঠীর কারও কারও যেমন অচিন্ত্য সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, প্রবোধ সান্ন্যাল প্রভৃতির লেখাও জয়তীতে স্থান পেতে লাগল। প্রবীণদের মধ্যে জয়তীতে লেখা দিয়েছেন প্রমথ চৌধুরী, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মোহিতলাল মজুমদার, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, দিলীপকুমার রায় প্রভৃতি। আর ঢাকা (মুসলিম) সাহিত্য সমাজকে কেন্দ্র করে যারা ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলন চালিয়ে ছিলেনÑ যেমন, কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হুসেন, কাজী মোতাহার হোসেন, আনওয়ারুল কাদীর প্রভৃতিও লিখতে লাগলেন ‘জয়তী’তে নিয়মিত। আর স্বয়ং নজরুল তো আছেন প্রতি সংখ্যায়।


৮.
আবদুল কাদির অনেক কবিতা ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তবে অন্যদের কবিতা প্রকাশে, সম্পাদনায় ও বিশ্লেষণে তিনি যতটা আগ্রহী ও উৎসাহী ছিলেন তার নিজের মৌলিক লেখালেখির ক্ষেত্রে ছিলেন ততটা উদাসীন। যার কারণে তার মৌলিক কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা অনেক কম। তাঁর উল্লেখযোগ্য কবিতা ও প্রবন্ধগ্রন্থ: দিলরুবা (১৯৩৩), উত্তর বসন্ত (১৯৬৭), কবি নজরুল (১৯৭০), ছন্দসমীক্ষণ (১৯৭৯), কাজী আবদুল ওদুদ (১৯৭৬), বাংলা ছন্দের ইতিবৃত্ত (১৯৮৫), যুগকবি নজরুল (১৯৮৬) ইত্যাদি। এগুলির মধ্যে সাহিত্য সমালোচনা ও ছন্দবিষয়ক গ্রন্থও রয়েছে। তিনি বাংলা ছন্দ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ও সামগ্রিক বিশ্লেষণ করেছেন, যা তাঁর ছন্দসমীক্ষণ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে।


৯.
আবদুল কাদির বেশকিছু সংখ্যক রচনাবলি সম্পাদনার কৃতিত্ব অর্জন করেন, যেমন: কাব্যমালঞ্চ (যুগ্মভাবে, ১৯৪৫), এয়াকুব আলী চৌধুরী রচনাবলী (১৯৬৩), নজরুল রচনাবলী (৫ খন্ড, ১৯৬৬-১৯৮৪), শিরাজী রচনাবলী (১৯৬৭), কাজী ইমদাদুল হক রচনাবলী (১৯৬৮), আবুল হুসেন রচনাবলী (১৯৬৮), লুৎফর রহমান রচনাবলী (১ম খন্ড, ১৯৭২), রোকেয়া রচনাবলী (১৯৭৩), বাংলা সনেট (১৯৭৪) ইত্যাদি।


১০.
সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ আবদুল কাদির বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৩), আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৭), একুশে পদক (১৯৭৬), নজরুল একাডেমী স্বর্ণপদক (১৯৭৭), কুমিল্লা ফাউন্ডেশন পদক (১৯৭৭), মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৭৭) ও মুক্তধারা পুরস্কার লাভ করেন।


১১.
কবি কাজী নজরুল ইসলামকে আবদুল কাদির পেয়েছিলেন সহযোদ্ধা, সহকর্মী, কৃত্রিম বন্ধু হিসেবে। নজরুলের সানি্নধ্য ও স্নেহে সিক্ত ছিলেন কবি। নজরুলের প্রতি তারও ভালোবাসার কমতি ছিল না। কাদির তার 'নজরুলের জীবন ও সাহিত্য' দীর্ঘ প্রবন্ধে তার ছন্দ মূল্যায়ন করেন_ 'বাল্য থেকেই নজরুলের ছন্দ ও সুরের কান প্রখর ছিল। তিনিই প্রথম রবীন্দ্রনাথের নবাবিষ্কৃত মুক্তক-স্বরবৃত্ত ছন্দে কবিতা লেখেন; এই ছন্দে যে ওজস্ সৃষ্টি চলে তা 'কামাল পাশা' লিখে প্রমাণ করলেন। তার 'বিদ্রোহী' সমিল মুক্তক মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত_ বাংলা ভাষায় তিনি এই নব-ছন্দের প্রবর্তক। নজরুল, রোকেয়া, সিরাজীর মতো আমাদের জাতিসত্তার ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোকে আরও প্রবলভাবে জানতে ও বুঝতে তার অবদান অনস্বীকার্য-অতুলনীয়, প্রাতিস্বিকও বটে। নজরুল বাঙালির চিন্তা- চেতনায় নানাভাবে হাজির হয়েছে কাদিরের শ্রম-নিষ্ঠা-এষণা ও প্রগাঢ় প্রেমের কল্যাণে। নজরুল আমাদের দেশ-মাতৃকার জাতীয় কবি। স্বাধিকারের লড়াইয়ে, স্বাধীনতার আন্দোলনে, মুক্তির সংগ্রামে নজরুলের সৃষ্টি সম্ভার যেমন প্রণোদিত করেছে, উজ্জীবনের মন্ত্র দিয়েছে, তেমনি দিয়েছে পরম নির্ভরতা ও বৌদ্ধিক চালিকাশক্তি। ব্রিটিশ বিরোধিতা ও আমাদের স্বাজাত্যবোধ জাগ্রত হওয়ার কালে তার লেখনী ছিল স্বাধীনতা ও মুক্তিপ্রিয় মানুষের অনিবার্য উচ্চারণ-সাহসী এক ইশতেহার।


১২.
আবদুল কাদিরই প্রথম নজরুল রচনাকে রক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করেন এবং নজরুল রচনা সংগ্রহ ও সম্পাদনার আলোকে রচনাবলি প্রকাশের উদ্যোগ নেন। অবশ্য এ কাজের আগেও আমরা পেয়েছি তার নজরুলপ্রীতির অনবদ্য সাক্ষাৎ। স্বাধীন বাংলাদেশে নয় শুধু, নজরুলের জন্মস্থান পশ্চিমবঙ্গেও যে কোনো গবেষক-সুহৃদ-শুভানুধ্যায়ীর আগেই তিনি শুরু করেছিলেন নজরুল চর্চা। আবদুল কাদির নজরুল রচনাবলি সংগ্রহ ও সম্পাদনার পাশাপাশি জীবনী রচনারও পথিকৃৎ। খোন্দকার সিরাজুল হক ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজ চিন্তা ও সাহিত্যকর্ম’তে লিখেছেন, ‘নজরুল-রচনাবলি রচনার প্রাথমিক প্রয়াস হিসেবে ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘নজরুল-পরিচিতি’ নামে নজরুল বিষয়ক প্রবন্ধের একটি সংকলন প্রকাশ করেছিলেন। গ্রন্থটি শুরু হয়েছে তার রচিত ‘কবির জীবনকথা’ দিয়ে। এ গ্রন্থে নজরুল-প্রতিভার বিভিন্ন দিক নিয়ে যারা লিখেছেন তাদের মধ্যে আবদুল কাদির, ইব্রাহীম খাঁ, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, মুহম্মদ এনামুল হক, বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ, মুহম্মদ আবদুল হাই (১৯১৯-৬৯), আব্বাসউদ্দীন আহমদ (১৯০১-১৯৫৯), আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯), সৈয়দ আলী আহসান, মুনীর চৌধুরী প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।


১৩.
সবশেষে কবি ও ছান্দসিক আবদুল কাদির রচিত একটি সনেটের ক’টি চরণ তুলে ধরছি-
আমার অঙ্গন ঘেরি ঘনায়েছে বাদলের রাত
সমস্ত আকাশ ভরি কাঁদে বায়ু বর্ষণ মুখর
নিঃশব্দ ভবনে মোর ভেসে আসে বনের মর্মর
ভেসে আসে দূর স্মৃতি ছায়া তব দেখি অকস্মাৎ। (সনেট)
(তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া, আবদুল কাদির বিমূর্ত এক বিস্মরণ, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা)
- সংগৃহীত 
Next Post Previous Post