মুসলিম উম্মাহর অবস্থা । দুঃখজনক হলেও আমাদের বর্তমান অবস্থা ঠিক তখনকার ন্যায়। আমরা এখন বিক্ষিপ্ত ভেড়ার পালের মতো
মুসলিম উম্মাহর অবস্থা । দুঃখজনক হলেও আমাদের বর্তমান অবস্থা ঠিক তখনকার ন্যায়। আমরা এখন বিক্ষিপ্ত ভেড়ার পালের মতো
সালজুক সুলতান মালিক শাহ ১০৯২ সনে মৃত্যু বরণের পর সঙ্গে সঙ্গেই সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠত্ব ও ঐক্য বিনষ্ট হয়ে যায়। মালিক শাহের ছেলেরা গৃহযুদ্ধ লিপ্ত হয়। শান্তিপূর্ণ ও গৌরবময় সাম্রাজ্য বিশৃঙ্খল ও অরাজকতার এক রাষ্ট্রে রূপ নেয়।
এদিকে আব্বাসিয়া সাম্রাজ্য আল- মুতাজিদের আমল থেকে অযোগ্য শাসকের যে ধারা শুরু হয়, তখন ঠিক একই অবস্থা অব্যাহত ছিল। খলিফাদের শাসনকার্যের প্রতি উপেক্ষা ও অবহেলা প্রদর্শন করে মদ, নারী নিয়ে ভোগ বিলাস ডুব দিয়ে থাকাই ছিল একমাত্র কাজ। সাম্রাজ্যের চারিদিকে অরাজকতা দেখা দেয়, সৈন্যবাহিনী উশৃংখল হয়ে উঠে।
অন্যদিকে কুচুক্রি ও স্বার্থপর আমির ওমরাহগণের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের গতি দিনে দিন বেড়েই চলছিল। আমীর ওমরাহগণ নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে বাগদাদের মুসলিমদের মধ্যে চরমমাত্রার দ্বন্দ্ব, আলেমদের মাজহাবি বিবাদ, ফিরকাগত ভিন্নতা, সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ইখলতিলাফি মাসয়ালা নিয়ে এক পক্ষের সাথে অন্যপক্ষের মারামারি কাটাকাটির মধ্যেই সকাল-বিকাল ব্যস্ত রাখতো।
অন্যদিকে মিশরে ফাতেমি শাসকগণ নিজেদের শিয়া ও সাম্রাজ্যের স্বার্থ পর্যন্তই তাদের কাজ সীমাবদ্ধ ছিল। ১০২১ সনে আলী মানসুর আল-হাকিমের মৃত্যুর পর তাদের মধ্যেও চরমমাত্রায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। ধারাবাহিকভাবে একের পর এক অযোগ্য শাসকরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। নামে মাত্রই যারা শাসক ছিলো।
ব্যহত তখন পুরো মুসলিম বিশ্বের চিত্রই এমন ছিল। ফিতনা-ফাসাদ ও মুসলিমদের অনৈক্য এসবই খুবই স্বাভাবিক ছিল। এই উপযুক্ত সময়টার অপেক্ষায় ছিল ক্রুসেডার বাহিনী। সময়ের সৎ ব্যবহার করতে ভুল করলো না। তাইতো ১০৯৮ খ্রিস্টাব্দে এশিয়া মাইনর দখল করে ঝড় তুফানের বেগে এন্টিয়ক হয়ে সিরিয়া জয় করে ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দে গডফ্রের নেতৃত্বে জেরুজালেম বিজয় করে। বলা হয়ে থাকে তারা সেদিন রক্তের সাগরে জেরুজালেম ভাসিয়ে দেয়। কয়েকবছরের মধ্যেই শাম অঞ্চলের সব শহর তারা জয় করলো। যতো সহজে বললাম এরচেয়েও বেশি সহজে।
ব্রিটিশ ঐতিহাসিক Stanley Lan Poel লিখেন, ‘ক্রুসেড বাহিনী মুসলিম বিশ্বের গভীরে এমনভাবে ঢুকে পড়লো যেমন পচা কাঠে পেরেক ঢুকে যায়’। শুনতে খারাপ লাগতে পারে তবে এটাই তিক্ত বাস্তবতা। আমরা তখন এই পঁচা কাঠের মতোই ছিলাম। ক্রুসেডাররা ছিল শক্ত পেরেকের ন্যায়, অনায়াসে মুসলিম বিশ্বে ঢুকে পড়ে।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয় বলে একটা কথা আছে। অনুরূপ ঘটনা আবার পুনরাবৃত্তি হয় ১০০ বছর পরেই তাতারিদের আগমনের মাধ্যমে। যদিও ক্রুসেড আক্রমণে মুসলিমদের ঐক্যের প্রতিক খিলাফত ব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়েনি। পড়তো যদি নুরুদ্দিন জেঙ্কি, সালাহউদ্দীন আইয়্যুবিরা উম্মাহর দুর্দিনের অবিভাবক হয়ে এগিয়ে না আসতো। কিন্তু তাতারিদের হাতে খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের পতনের পর যখন মুসলিমদের মাঝে কোনধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়নি তখন খিলাফতের রাজধানী বাগদাদ পতন ভাগ্যের লিখন হয়ে যায়।
ক্রুসেডারদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হওয়ার পর যে মুসলিমরা নিজেদের পরিবর্তন করেছিলো, এমনটা হয়নি। তাই পূর্বের চেয়েও কঠিন দিন আসে মুসলমানদের ভাগ্যে। ইতিহাসের সর্ববৃহৎ ঝড়ের আক্রমণের শিকার হয়।
এরপরেও একটা দল ছিলো যারা সকল পরাজিত মানসিকতা, হীনমন্যতা ছুড়ে ফেলে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর দিকে অগ্রসর হয়। ফলস্বরূপ উসমানীয় সালাতানাতের গোড়াপত্তন হয়।
-
এই ইতিহাস বলার কারণ, খুব দুঃখজনক হলেও আমাদের বর্তমান অবস্থা ঠিক তখনকার ন্যায়। আমরা এখন বিক্ষিপ্ত ভেড়ার পালের মতো। এই সময় আমাদের উপর হিংস্র নেকড়ের আক্রমণের সবচেয়ে মোক্ষম সুযোগ। জানি না কখন না জানি সেই হিংস্র নেকড়ের দলেরা আমাদের উপর হামলে পড়ে। যদি আমরা এই বিপদ উপলব্ধি করতাম, তাহলে সেই অন্ধকার দিনের জন্য সবাই তাওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করতাম। কিন্তু কারো মধ্যেই সেই ভাবলেশ নেই।
আমরা এখনো ফুরুয়ি ইখতিলাফ নিয়ে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে ব্যস্ত। জিকির আস্তে ও জোরে পড়া, তারাবিহর রাকাত সংখ্যা, নামাজে হাত বাঁধা ইত্যাদি ইখতিলাফি মাসয়ালা নিয়ে একে অপরের সাথে ঝগড়াঝাটি আর বিরোধিতায় লিপ্ত। ওয়ালা বারা- এর প্রকৃত রূপ এখন হারিয়ে গিয়েছে। আসহাবিয়্যাত এখন ওয়ালা বারা- এর ভিত্তি হয়ে দাড়িয়েছে।