মসজিদ আর জামাত নিয়ে এতো চুল্কানি কেনো?

"ভাইরাসে পুরো বসরার লোকজন মারা গিয়েছিল। লাশ দাফনের লোক পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। প্রয়োজনে দূরের লোকজন ভাড়া করে এনে দাফনকাজ সম্পন্ন করতে হয়েছিল। বসরার অলিগলি ভরে গিয়েছিল লাশ আর লাশে। তবুও জুমার নামাজ বন্ধ হয়নি। মাত্র হলেও আটজন মুসল্লি হাজির হয়েছিল।"


যেসব মুসলিম ভায়েরা অতি বুঝদার অতি সচেতন হতে গিয়ে মুনাফিক মুরতাদদের ফাদে পড়ে মসজিদ বন্ধ করতে উঠে পড়ে লাগছেন তাদের জন্য কিছু কথা...

৬৮৮ খ্রিষ্টাব্দের তাউনে জারিফ বা জারিফ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়েছিল ইরাকের বসরায়। তখন বসরা ছিল হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর রা.-এর শসানাধীন এলাকায়। তখনও অনেক সাহাবি বেঁচে ছিলেন দুনিয়ায়।

ভাইরাসটি স্থায়ী ছিল মাত্র চারদিন। কিন্তু এ চারদিনেই বসরার প্রায়সব মানুষ মরে শেষ হয়ে যায়। প্রথমদিনে ৭০ হাজার, দ্বিতীয়দিনে ৭২ হাজার, তৃতীয়দিনে ৭৩ হাজার, চতুর্থদিনে তো গুটিকতক লোক ছাড়া বাকি সবাই মৃত্যুমুখে পতিত হয়!

এতবেশি পরিমাণ লোক মারা যায় যে, দাফন-কাফনের কোনো লোক খুঁজে পাওয়া যায়নি। স্বয়ং বসরার গভর্নরের মায়ের দাফন-কাফনের জন্য চারজন লোককে ভাড়া করে আনা হয়েছিল।

বসরার অলিগলি ভরে গিয়েছিল মরা লাশের স্তুপে। বন্য প্রাণীরা বেরিয়ে এসে, লাশগুলো ছিঁড়েফেড়ে খেয়েছিল। চিল, শকুন আর কাকের দল তো ছিলই। বলতে গেলে, বসরা হয়ে গিয়েছিল মৃত্যুপুরী।

বসরার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে জুমার নামাজে মাত্র সাতজন পুরুষ আর একজন নারী মুসল্লি উপস্থিত হয়েছিল। খুতবায় ইমাম সাহেব বলেছিলেন--আগের চেহারাগুলো কোথায়, দেখি না কেন? মহিলা উত্তর দিয়েছিলেন--চেহারাগুলো মাটির নিচে!

ভাইরাসে পুরো বসরার লোকজন মারা গিয়েছিল। লাশ দাফনের লোক পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। প্রয়োজনে দূরের লোকজন ভাড়া করে এনে দাফনকাজ সম্পন্ন করতে হয়েছিল। বসরার অলিগলি ভরে গিয়েছিল লাশ আর লাশে। তবুও জুমার নামাজ বন্ধ হয়নি। মাত্র হলেও আটজন মুসল্লি হাজির হয়েছিল।

উপলব্ধি : করোনাভাইরাসে আমাদের অবস্থা এখনো জারিফ ভাইরাসের মতো হয়ে যায়নি। কিন্তু মসজিদগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এমনকী জুমা পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হলো। অথচ, জারিফ ভাইরাসের প্রাদুর্ভূত এলাকা বসরায় তখনও অনেক সাহাবি ছিলেন। ছিলেন অনেক তাবেয়ি ও বড় বড় উলামা-মাশায়িখ। কই, তারা তো মসজিদ বন্ধের ফতোয়া দেননি?

ফতোয়া জারি করার জন্য অনেক দলিল পাওয়া যেতে পারে, তা ঠিক। কিন্তু আমাদের সালাফদের নীতি কেমন ছিল, তা কি দেখতে হবে না? কঠিন মহামারিতে আক্রান্ত হবার পরও কি তারা মসজিদ-নামাজ-জুমা বন্ধ করার ফতোয়া দিয়েছিলেন?



সূত্র : কিরকুক বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রকাশিত ম্যাগাজিনে নাসির বাহজাত এর আরবি আর্টিকেল 'আত-তাওয়ায়িন ফি সাদরিল ইসলাম ওয়াল খিলাফাতিল উমাওয়িয়্যাহ' হতে চয়িত।




হিজরি ৬৯ বর্ষ।
খ্রিষ্টীয় ৬৮৮ শতাব্দী।
মুসলিম বিশ্বে উমাইয়া শাসন চলছে। তবে মক্কা-মদিনায় ছিল আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর রা.-এর নিয়ন্ত্রণ। মক্কা-মদিনার শাসনকে কেন্দ্র করে বনু উমাইয়া আর আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর রা.-এর মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা তুঙ্গে, তখন বসরায় দেখা দেয় মহামারি। ইতিহাসে এই মহামারিকে তাউনে জারিফ বলা হয়। আধুনিক পরিভাষায় বলতে হলে জারিফ ভাইরাস বলতে হয়।

জারিফ শব্দটি আরবি। অর্থ নিষ্কাশনকারী। বানের পানি যেভাবে সবকিছু নিষ্কাশিত করে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তদ্রুপ এই মহামারিও সব মানুষকে নিয়ে গিয়েছিল। এতবেশি মানুষ এই মহামারিতে মারা যায় যে, মহামারির নাম জারিফ হয়ে যায়। এই মহামারি স্থায়ী ছিল চারদিন।প্রথমদিনেই মারা যায় ৭০ হাজার লোক! দ্বিতীয়দিন মারা যায় ৭১ হাজার লোক! তৃতীয়দিন মারা যায় ৭৩ হাজার লোক! আর চতুর্থদিন তো হাতেগুনা লোক ছাড়া বাকি সবাই মারা যায়!

এই মহামারিতে যারা মারা যান, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন প্রসিদ্ধ নাহুশাস্ত্রবিদ ইমাম আবুল আসওয়াদ দুঈলি। এমনকী এই মহামারিতে মারা যান স্বয়ং বসরার গভর্নর ইবনে মামরের মাতা। তার লাশ কাফন-দাফন করার জন্য কোনো মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত চারজন ভাড়াটে লোককে এনে কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করা হয়।

তারিক বিন শিহাব বাজালি। প্রসিদ্ধ তাবেয়ি। গণবিধ্বংসী এই মহামারির সময়ে কয়েকজন লোকসহ তিনি হজরত আবু মুসা আশআরি রা.-এর কাছে আসেন। আলাপচারিতা করার জন্য। আবু মুসা বাড়িতেই ছিলেন। তিনি তখন কুফার গভর্নর। তারিক বিন শিহাব বাজালি তার সঙ্গীদের নিয়ে যখন বসতে গেলেন, তখন আবু মুসা আশআরি শশব্যস্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন, 'আপনারা নগ্নপায়ে হাঁটবেন না। এ ঘরে একজন লোক মহামারিতে আক্রান্ত। মহামারির প্রাদুর্ভাব শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত এই গ্রাম থেকে বেরিয়ে, আপনারা আপনাদের প্রশস্ত শহরের মুক্ত বাতাসে গিয়ে শ্বাস নিতে পারেন।'

খুব খেয়াল করলে দেখবেন, আজ থেকে হাজার বছর পূর্বে, করোনার মতো জারিফ নামক গণবিধ্বংসী ভাইরাসের প্রতিরোধে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একজন সাহাবি হজরত আবু মুসা আশআরি রা. কতটা সচেতন ছিলেন! তার ঘরে আগত মেহমানদেরকেও সতর্ক করেছিলেন। নগ্নপদে ঘরে হাঁটতে নিষেধ করেছিলেন। এমনকী তাদেরকে ভাইরাসাক্রান্ত গ্রাম থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজেদের শহরের মুক্ত বাতাসের অবগাহন করার পরামর্শ দিয়েছিলেন।

ইসলামে ছোঁয়াচে রোগ বলতে কিছু নেই--তা ঠিক। তাই বলে সতর্কতা ও সচেতনতা অবলম্বন করা যাবে না--এমন নয়। আপনাকে যথাসম্ভব সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। হজরত আবু মুসা আশআরি রা.-এর কথা থেকে আমরা এমনই শিক্ষা পাই। তাই আসুন, দুআ ও ইস্তিগফারের পাশাপাশি সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করি।
-------
সূত্রাবলি :
*আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৮/২১২, ইমাম ইবনে কাসির।
*তারিখুল ইসলাম : ৩/১২৯, ইমাম শামসুদ্দিন জাহাবি।
*তারিখুল মুলুক ওয়াল উমাম : ৫/১২, ইমাম তাবারি।
Ainul Haque Qasimi
Next Post Previous Post