প্রকৃত অভাবী কারা? কাকে বেশি সাহায্য করা দরকার?

আসল মিসকিন নকল মিসকিন : অভাবী কে সাহায্য করা



লকডাউনের সময়কার কথা।

গ্রাম্য একটি বাজারের ফার্মেসিতে কজন তরুণ আলেমের সাথে বসা ছিলাম। বেশ আলাপ জমেছিল তখন। ওই বাজারটা আমাদের এলাকা থেকে অনেক দূরে। বিশেষ এক প্রয়োজনে গিয়েছিলাম ওখানে। আমার আসার খবর শুনে ওই এলাকার অদেখা কজন আলেমভাই এসেছিলেন দেখা করতে। আর তখনই সেই গল্পের আসরটা জমে উঠেছিল।


যেহেতু লকডাউন চলছিল, সেহেতু গল্পের সিংহভাগ জুড়ে রয়েছিল করোনাভাইরাস-বিষয়ক আলাপ। দুঃসহ ওই সময়ে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের দুঃখকষ্ট, সরকারি সহায়তা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও আমলাদের চুরিচামারি, আলেমদের মানবেতর দিনাতিপাত, সমাজের হৃদয়বান ব্যক্তিদের দিলখোলা সাহায্য, এবং এক্ষেত্রে আলেমসমাজের চোখেপড়ার মতো ভূমিকাগ্রহণ- ইত্যাদি আলাপ চলছিল।


লকডাউনে সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছে আলেমসমাজ, মাদরাসা বন্ধ থাকায় সামান্য কিছু যে হাদিয়া মিলত, তাও না পাবার কারণে তাদের এই দুরবস্থা- রঙচায়ের ধোয়াউড়া পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে কথাটা বললেন উপস্থিত আলেমদের একজন। সকলেই মাথা নেড়ে সায় জানালেন। কিন্তু ব্যক্তিক্রম ছিলেন একজন; তিনি বললেন- ভুল কথা; কোনো আলেমই কষ্টে নেই। সবার মধ্যে আলেমদের অবস্থা ভালো। আল্লাহ আলেমদেরকে ভালোমতো খাওয়াচ্ছেন! কোনো আলেমকেই না খেয়ে আছেন- এমন দেখিনি!


শশব্যস্ত কণ্ঠে কথাটার প্রতিবাদ করে উঠলেন উপস্থিত সকলে। এতে করে ব্যতিক্রমী কথার অধিকারী ওই আলেম একেবারে চুপসে গেলেন। যিনি আলেমদের কষ্টের কথা বলেছিলেন, তিনি এমনই এক গল্প শুনালেন, যা শোনে উপস্থিত সকলের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠেছিল। তার গল্পের সারসংক্ষেপ হলো এই-


ওই এলাকারই একজন আলেম। একটি ছোটখাটো কওমি মাদরাসায় সহকারী শিক্ষক তিনি। হাজার চারেক টাকা বেতন ছিল তার। সামান্য এই কটা টাকা দিয়ে এমনিই অনেক টানাটানি করে সংসার চালাতেন তিনি। পানি ছাড়া সংসারের সবকিছুই কিনতে হতো তাকে। তার উপর সারাবছর তার বাচ্চাকাচ্চা ও স্ত্রী অসুস্থ থাকত। দারিদ্র্যের কষাঘাত সহ্য করেই তিনি তিন গুজরান করতেন। কাছের অনেকেও তা বুঝতে পারত না। আসলে তিনি বুঝতে দিতেন না। বড় গাইরতমন্দ ছিলেন তিনি।


কিন্তু লকডাউনের সময় তিনি একেবারে মিসকিন হয়ে যান। শুরুতে কয়েকদিন টেনেটুনে চলে গেলেও পরে আর সম্ভব হয়নি। লজ্জা, সংকোচ, দ্বিধাবোধ ও গাইরতের কারণে কারও কাছে চাইতেও পারতেন না। এবং এই কারণে প্রকাশ্যে জনসম্মুখে, লাইনে দাঁড়িয়ে সরকারি রিলিফও আনতে পারতেন না। সমাজের হৃদয়বান ব্যক্তিরা যা তার ঘরে পৌঁছিয়ে দিত, সেগুলোতেই অল্পেতুষ্ঠ থাকতেন। কিন্তু আট-দশজন মানুষের পরিবারে এগুলোতে আর কতদিনই বা চলে?


তখনও রমজানের রোজা শুরু হয়নি। তারা মিয়াঁ-বিবি পানি পান করে নিয়মিত রোজা রাখতেন। বাচ্চাদেরকে এইসেই কিছু একটা খাবার মিলিয়ে দিয়ে সন্তুষ্ট রাখতে চাইতেন। এরপরও তারা দৈনিক এক- দুবেলা উপোস থাকত। জঠরযন্ত্রণায় প্রায়সময় তারা কান্নাকাটি করত। এভাবে একসময় রমজান চলে আসে। সমাজের সকলেই একমাস রোজা রাখল; আর তারা প্রায় কয়েক মাস!

_______
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদিস আছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- ওই ব্যক্তি মিসকিন নয়; যে এক-দুইটি খেজুর কিংবা এক-দুমুঠো খাবারের জন্য মানুষের দ্বারেদ্বারে ঘুরে ফেরে; বরং প্রকৃত মিসকিন ওই ব্যক্তি, যে মানুষের কাছে হাত পাতে না।


অর্থাৎ- পেশাদার ভিক্ষুক যে, সে মানুষের কাছে হাত পাতে, মানুষও তাকে দেয়। এতে করে তার প্রয়োজন মিটে যায়। কিন্তু যে তার লজ্জাবোধ কিংবা সংকোচবোধ অথবা জড়তার কারণে কারও কাছে হাত পাততে পারে না, সে অলক্ষ্যে অভুক্তই থেকে যায়। সে হিসেবে তাকেই সাদাকাহ দেওয়া অধিক জরুরি। কারণ, সে-ই প্রকৃত মিসকিন।


পুনশ্চ : আজ সহিহ বুখারির দারসে হাদিসটি পড়ানোর সময় ওই গল্পটি মনে পড়ে গেল। ছাত্রদেরকে হাদিসের ব্যাখ্যা করে দিলেও গল্পটি বলিনি। এখানে বললাম।

- Ainul Haque Kasemi

Next Post Previous Post