আধুনিক বিজ্ঞান ও মুসলিম সালাফদের অবস্থান।

আধুনিক অনেক মুসলিমকে আমরা বলতে শুনি যে, ‘বর্তমান বিজ্ঞান অমুক কথা বলছে, যা সালাফদের মতের বিরোধী। এজন্য আমাদের নুসুসে শরিয়াহকে সালাফদের বুঝ বাদ দিয়ে বিজ্ঞানের আলোকে বুঝতে হবে। কারণ আগেকার যুগে বর্তমানের মতো বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধিত হয়নি। যার ফলে সালাফরা এসব বিষয় বুঝতে পারেননি কিংবা তাদের কাছে বিষয়গুলো বর্তমানের মতো স্পষ্ট হয়নি। এখন বিজ্ঞান এসে অনেক বিষয়ই আমাদের সামনে স্পষ্ট করে দিয়েছে।’

বইঃ বিজ্ঞান ও ফাহমুস সালাফ, লেখকঃ ইফতেখার সিফাত  

বিজ্ঞান শব্দটা অনেক ব্যাপক একটা বিষয়। এর বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা আছে। বিজ্ঞানের প্রধান দুটি শাখা হলো—‘সামাজিক বিজ্ঞান’ ও ‘প্রাকৃতিক বিজ্ঞান।' প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের আবার অনেক শাখা আছে। এর মধ্যে পদার্থ, রসায়ন, মহাকাশ, চিকিৎসা, জীববিজ্ঞান অন্যতম।
এবার ইসলামের আলোকে আমরা বিজ্ঞানকে দুই ভাগে ভাগ করব আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদিসের ভিত্তিতে। হজরত রাফি ইবনে খাদিজ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় আগমন করে মদিনাবাসীদেরকে খেজুর গাছে পরাগ যোগ করতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা এটা কী করছ? উত্তরে বলা হলো, আমরা এমন করে থাকি। তিনি বললেন, এমন না করলে হয়তো ভালো হবে। অতঃপর তারা এ কাজ ছেড়ে দিল। এতে খেজুরের ফলন ভালো হলো না। তারা এ সংবাদ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পৌঁছালে তিনি বললেন, আমি তো একজন মানুষ। যখন তোমাদের দীন সম্পর্কীয় কোনো বিষয়ে আদেশ করি, তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পালন করবে। আর যখন আমার ব্যক্তিগত অভিমত হিসেবে কোনো কিছু বলি (তাহলে তা মান্য করা আবশ্যক নয়), কেননা আমি তো একজন মানুষ। অন্য এক রেওয়ায়েতে আছে, তিনি বলেন, ‘তোমরা তোমাদের দুনিয়াবি বিষয়ে খুব ভালো জানো।’
যে বিষয়গুলো শরয়ি ইলমের সাথে সম্পৃক্ত নয় এবং যে বিষয়ের ব্যাপারে ইসলামের সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই, তা পার্থিব বিষয়। যেমন আমরা কীভাবে চাষ করব, কীভাবে গাছ রোপন করব, পরিচর্যা করব এই বিষয়গুলো শরয়ি ইলমের সাথে সম্পৃক্ত নয়; বরং এই বিষয়গুলো মানুষের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের ওপর নির্ভরশীল। ফলে মানুষ নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের ফলে যে পদ্ধতি উত্তম মনে করবে, সেটাই অনুসরণ করবে।
এখন আমরা হাদিসটিকে বিজ্ঞানের ওপর প্রয়োগ করব।



বিজ্ঞানের যে বিষয়গুলো শরয়ি ইলমের সাথে সম্পৃক্ত, সেসব নুসুসে শরিয়াহকে আমরা সালাফদের ফাহমের আলোকেই গ্রহণ করব। আর যে বিষয়গুলো শরয়ি ইলমের সাথে সম্পৃক্ত নয়, সেগুলোর ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তকে অনুসরণ করতে পারি। যেমন মহান আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বলে দিয়েছেন, তিনি প্রকৃতির সৃষ্টিকর্তা, তিনিই প্রকৃতির সকল কিছু পরিচালনা করেন। কিন্তু কোন কোন প্রক্রিয়ায় তিনি এগুলো পরিচালনা করেন, তার বিস্তারিত বিবরণ তিনি আমাদের জানাননি। এমনিভাবে সৌরজগৎ সম্পর্কেও বিস্তারিত বর্ণনা তিনি আমাদের দেননি।
ফলে এই জায়গাগুলোতে বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা গ্রহণ করার অবকাশ আছে। এমনিভাবে পদার্থ, রসায়ন, চিকিৎসা ইত্যাদি বিজ্ঞানের প্রায় বিষয়ই হাদিসে বর্ণিত উমুরে দুনিয়ার (পার্থিব বিষয়) অন্তর্ভুক্ত। এই বিষয়গুলো মানুষের গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের ওপর নির্ভরশীল। ফলে বিজ্ঞানের এই দিকগুলোতে ইসলামি শরিয়ার বিশেষ কোনো নির্দেশনা নেই। সকল কিছুর মালিক আল্লাহ, সকল জ্ঞান আল্লাহপ্রদত্ত— এই বিশ্বাস রেখে মানুষ এসব বিষয়ে নিজস্ব গবেষণা ও অনুসন্ধানের ভিত্তিতে যা উত্তম ও কার্যকর মনে করবে, তাই গ্রহণ করবে।
পক্ষান্তরে বিজ্ঞানে যেসব বিষয় শরয়ি ইলমের সাথে সম্পৃক্ত এবং যেগুলোর ব্যাপারে নুসুসে শরিয়ায় সুস্পষ্ট বর্ণনা আছে, সেগুলো আমাদেরকে সালাফদের ফাহম ও মানহাজ অনুযায়ীই গ্রহণ করতে হবে।
সমস্যা হলো, আমরা এই বিভাজনকে মাথায় রাখি না। যার দরুন দেখা যায়, আমাদের কেউ কেউ ইসলামি জ্ঞানশাস্ত্রের স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য অনেক বিষয়কে অবৈজ্ঞানিক কিংবা বিজ্ঞানবিরোধী বলে নুসুসে শরিয়াহর বিকৃত ব্যাখ্যার দাবি তোলে। উদাহরণস্বরূপ আধুনিক সমাজ বিজ্ঞান বা রাষ্ট্র বিজ্ঞানের কথাই ধরা যাক। সমাজব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে নুসুসে শরিয়াহর স্বতন্ত্র ও মৌলিক নির্দেশনা-প্রস্তাবনা আছে। এগুলো নিছক মানুষের আকল বা অভিজ্ঞতা-নির্ভর বিষয় নয়। কিন্তু আজকে মুসলিমদের অনেকে পশ্চিমা-সমাজ বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোকে নুসুসে শরিয়াহর এমন ব্যাখা করছে, যা সালাফে সালেহিন থেকে প্রমাণিত নয়; বরং এগুলো তাদের বুঝের বিরোধী। গণতন্ত্র, সেকুলারিজম ইত্যাদি ব্যবস্থাকে পরম মনে করে সালাফদের থেকে প্রাপ্ত নুসুসে শরিয়াহর মুতাওয়ারিস ফাহম ও মানহাজকে প্রত্যাখ্যান করছে এবং নুসুসে শরিয়াহর ভ্রান্ত তাবিলের (ব্যাখ্যা) আশ্রয় নিচ্ছে।
যেমন ইসলামি শুরা-ব্যবস্থার কথা আমরা এখানে উদাহরণ হিসেবে আনতে পারি। সালাফে সালেহিন থেকে শুরু করে ইসলামের ১৪শ বছরের ইতিহাসে যে ব্যাখ্যা আমরা জেনে আসছি সেটা হলো, আহলুল হাল্ ওয়াল আকদ এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পরিষদের ভিত্তিতে শাসক নিয়োগ ও দেশ পরিচালনাকে শুরায়ি নিজাম বলে; যে পরিষদ কুরআন-সুন্নাহকে দেশ পরিচালনার ভিত্তি হিসেবে মেনে নেয়। কিন্তু কেউ কেউ পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পরম মনে করে ইসলামের শুরা ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক ব্যাখ্যা প্রদান করছে, যা সালাফে সালেহিনের কারও থেকে প্রমাণিত নয়। অনুরূপ সেকুলারিজমকে ইসলামিকরণের জন্য সালাফে সালেহিনের ফাহমকে পরিত্যাগ করে নুসুসে শরিয়াহর নতুন নতুন ব্যাখ্যা প্রদান করছে। পশ্চিমা মুক্তচিন্তাকে পরম মনে করে, সালাফে সালেহিনের মতকে উপেক্ষা করে নুসুসে শরিয়ার উদ্ভট ব্যাখ্যা প্রদান করছে।
বিবর্তনবাদের বিষয়টিও শরয়ি ইলমের সাথে সম্পৃক্ত। মানুষের সৃষ্টি সম্পর্কে নুসুসে শরিয়ায় আমরা সুস্পষ্ট বিবরণ পাই। মানুষের সৃষ্টিকেন্দ্রিক নুসুসে শরিয়াহর ফাহমে মুতাওয়ারিস আমরা সালাফদের থেকে পেয়েছি; কিন্তু বিজ্ঞান দ্বারা প্রভাবিত অনেক মুসলিম নুসুসে শরিয়াহকে পরম মনে করার পরিবর্তে বিবর্তনবাদকে প্রমাণিত হিসেবে বিশ্বাস করে নিয়েছে। আর সে বিশ্বাসের জায়গা থেকে নুসুসে শরিয়াহকে বিবর্তনবাদের সাথে মিলানোর জন্য নুসুসে শরিয়াহর এমন এমন উদ্ভট ব্যাখ্যা আবিষ্কার করছে, যা সালাফে সালেহিন থেকে প্রমাণিত নয়।
এই ভুলগুলো হচ্ছে বিজ্ঞানের উল্লিখিত বিভাজনটি না বোঝার কারণে। নুসুসের সূত্রে সালাফদের থেকে মুতাওয়ারিস যে ফাহম ও মানহাজ আমরা লাভ করেছি, সেগুলো নিছক মানুষের আকল কিংবা অভিজ্ঞতা-নির্ভর নয়। এই বিষয়গুলোতে আধুনিক বিজ্ঞান নুসুসে শরিয়াহ ও সালাফদের ফাহমের বিপরীতে গেলে কোনো প্রকার তাবিল ছাড়াই আমরা নুসুসে শরিয়াহ ও সালাফদের ফাহমের ওপর বিশ্বাস রাখব। কারণ মানুষের আকল, গবেষণা ও অভিজ্ঞতা পরম কোনো সত্য নয় এবং তা বিভিন্ন ধরনের প্রবণতা ও দুর্বলতা থেকেও মুক্ত নয়। ফলে শরয়ি ইলমের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়গুলোর সাথে বিজ্ঞান সাংঘর্ষিক হলে আমরা বিশ্বাস করব, অপূর্ণ জ্ঞান ও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে বিজ্ঞান প্রকৃত তত্ত্ব এখনো আবিষ্কার করতে পারেনি, কিংবা সেই পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি।
আর যেসব বিষয় শরয়ি ইলমের সাথে সম্পৃক্ত নয়, বরং উমুরে দুনিয়া তথা পার্থিব বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত, সেসব বিষয়ে মানুষের গবেষণা, অভিজ্ঞতা ও পর্যালোচনাই ধর্তব্য হবে। কারণ এই বিষয়গুলোকে উমুরে দুনিয়া হিসেবে ইসলাম আমাদের জ্ঞানের কাছে ছেড়ে দিয়েছে। যেমনটা হাদিস শরিফ থেকে আমরা জানতে পেরেছি।
এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে। বর্তমান অনেক মুসলিমই নুসুসে শরিয়ার বিষয়বস্তুকে বুঝতে ভুল করছে। যার দরুন তারা খুবই নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলভাবে নুসুশে শরিয়ায় এমন বিষয় খোঁজে বা নুসুসে শরিয়াহ থেকে জোরপূর্বক এমন বিষয় প্রমাণ করতে চায়, যা এর বিষয়বস্তু না। যেমন কেউ কেউ কুরআন থেকে সমস্ত বৈজ্ঞানিক থিউরি ও আবিষ্কারকে প্রমাণ করতে চায়। আর এমন একটা হীনম্মন্যতায় ভোগে যে, যদি কুরআন থেকে এগুলো প্রমাণ না করা যায়, তাহলে কুরআন অসম্পূর্ণ বা ছোট হয়ে যাবে। এজন্য তারা একনিষ্ঠভাবে কুরআন থেকে বৈজ্ঞানিক থিওরি প্রমাণের জন্য প্রাণপন চেষ্টা করে যান। আর এটা করতে গিয়ে অধিকাংশ সময় কুরআনের আয়াতের অর্থ ও মর্মকে বিকৃত করে ফেলেন।
অথচ কুরআনের মূল বিষয়বস্তু সাইন্স নয়। যদিও মহান আল্লাহ তাআলা কুরআনের কিছু কিছু জায়গায় প্রাসঙ্গিকভাবে সৃষ্টিগত ও প্রাকৃতিক কিছু বাস্তবতা শিক্ষণীয় হিসেবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। এজন্য যদি কুরআনে (নুসুসে শরিয়ায়) বৈজ্ঞানিক কোনো বাস্তবতা পাওয়া যায়, তাহলে নিঃসন্দেহে আমাদেরকে সেটার ওপরই বিশ্বাস রাখতে হবে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক কোনো থিউরি পূর্ব থেকেই মাথায় রেখে জোরপূর্বক কুরআন (নুসুসে শরিয়াহ) থেকে সেটা প্রমাণ করতে যাওয়া—চিকিৎসাশাস্ত্রের কিতাব থেকে আইন শাস্ত্রের বিষয় বের করার মতই অহেতুক কাজ।
পবিত্র কুরআন তার মূল বিষয়বস্তু ও অবতরণের উদ্দেশ্যে কোনো অস্পষ্টতা রাখেনি। প্রায় ২০টির মতো আয়াতে কুরআন স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, তাকে কেন নাজিল করা হয়েছে? উদাহরণস্বরূপ নিম্নে বর্ণিত কিছু আয়াতের দিকে আমরা মনোনিবেশ করতে পারি। সুরা মায়েদা ১৫, ১৬, ১৯, ৪৮, সুরা আনআম ৫৫, সুরা সিজদাহ ১-৩, এই আয়াতগুলো।
এখানে মাত্র কয়েকটি আয়াত আমরা তুলে ধরলাম। এরকম আরও আয়াত পবিত্র কুরআনে আছে; যেগুলো নিয়ে চিন্তা করলে বোঝা যায়, কুরআনে কারিমের মূল উদ্দেশ্য হলো, মানুষকে পরকালের জন্য প্রস্তুত করা এবং দুনিয়ার জীবনকে আল্লাহর সন্তুষ্টি মোতাবেক পরিচালনা করার জন্য গাইডলাইন দেওয়া। এর সাথে প্রাসঙ্গিকভাবে যেসব ঐতিহাসিক ঘটনা ও প্রাকৃতিক বাস্তবতা আল্লাহ তাআলা তুলে ধরেছেন, সেগুলোও উল্লিখিত উদ্দেশ্যকে শক্তিশালী ও বাস্তবায়নের জন্যই। এজন্য কুরআনে কোনো ঘটনা কিংবা বৈজ্ঞানিক থিউরি পাওয়া না গেলে সেটা দোষের কিছু না, হীনতায় ভোগারও কোনো বিষয় না। কারণ কুরআন কখনো নিজেকে বিজ্ঞানের গ্রন্থ বলে দাবি করেনি। এটা তার উদ্দেশ্যও না।
কুরআন তার বিষয়বস্তুর বিবেচনায় সামাজিক বিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত। এজন্য ইসলাম আমাদেরকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মৌলিক দিকনির্দেশনা দিয়েছে। যেন আমাদের পুরো জীবন আল্লাহর সন্তুষ্টি মোতাবেক পরিচালিত হয়। কিন্তু বিষয়বস্তুর বিবেচনায় কুরআন প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সাথে সংশ্লিষ্ট না; বরং এই দিকটিকে উমুরে দুনিয়া তথা পার্থিব বিষয় হিসেবে কুরআন মানুষের অনুসন্ধান ও গবেষণার ওপর ছেড়ে দিয়েছে। শর্ত হলো, এই গবেষণার উদ্দেশ্য হতে হবে মানুষের উপকার সাধন ও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন। তবে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার যে বিষয়গুলো প্রাসঙ্গিকভাবে নুসুসে শরিয়ায় এসেছে, সেগুলোতে আমাদেরকে নিঃসন্দেহে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে, যদিও আধুনিক বিজ্ঞান সেগুলোর বিরুদ্ধে যায়।
এ ক্ষেত্রে আমরা মনে করব, বিজ্ঞান তার সীমাবদ্ধতার কারণে প্রকৃত বাস্তবতায় পৌঁছতে পারেনি, কিংবা মন্দ কোনো প্রবণতার শিকার হওয়ার ফলে তার গবেষণা পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে গেছে। আর প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের যে বিষয় সুস্পষ্টভাবে কুরআনে বর্ণিত নেই, সেগুলোকে জোর করে, আনএকাডেমিক পদ্ধতিতে, নসের অর্থ ও প্রেক্ষাপটকে ভেঙেচুরে প্রমাণ করতে যাওয়া ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই না। এটা নিঃসন্দেহে নুসুসে শরিয়াহর বিকৃতি।
আমরা এরকম ভয়াবহ একটা উদাহরণ এখানে তুলে ধরছি। যখন বিজ্ঞানের এই থিউরি সামনে আসল যে, দুনিয়া স্থির নয় বরং ঘূর্ণায়মান, তখন এটাকে কুরআন থেকে প্রমাণ করার জন্য নিম্নের আয়াতটি ব্যবহার করা হলো —
‘আর যখন তোমরা পাহাড়কে দেখবে তখন মনে হবে সেটা স্থির হয়ে আছে। অথচ তা মেঘের মতো চলতে থাকবে।’
এই আয়াতে ‘পাহাড় মেঘের মতো চলতে থাকবে’ অংশটুকুর অর্থ বিকৃত করে ‘পাহাড় মেঘের মতো চলে’ অর্থ করে তারা দাবি করল যে, দুনিয়ার ঘূর্ণায়মান হওয়ার থিউরি কুরআন দ্বারাও প্রমাণিত। অথচ এটা মোটেও আয়াতের বিষয়বস্তু না। আয়াতে মোটেও দুনিয়া স্থির না ঘূর্ণায়মান—এই ব্যাপারে কথা বলা হয়নি। আয়াতের কনটেক্সট (পূর্বাপর) থেকে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়, এখানে কিয়ামতের অবস্থা বর্ণনা করা হচ্ছে। কিয়ামত এতই ভয়াবহ হবে যে, আমরা এতদিন যেই পাহাড়গুলোকে স্থির দেখে আসছি, সেদিন এই পাহাড়গুলো আকাশে মেঘের মতো উড়তে থাকবে। এটাই উল্লিখিত আয়াতের প্রেক্ষাপট। কিন্তু কুরআন দিয়ে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সকল থিউরি প্রমাণ করার ভূত মাথায় থাকার কারণে আয়াতের এই প্রেক্ষাপট ও প্রকৃত মর্মকে চুরমার করে দেওয়া হয়েছে। এরকম আরও অসংখ্য দৃষ্টান্ত আছে। যেখানে কুরআন থেকে বৈজ্ঞানিক থিওরি প্রমাণ করতে গিয়ে এভাবেই আয়াতের মর্মের বিকৃতি-সাধন করা হয়েছে।
মোটকথা কুরআনে কারিম পদার্থ বিজ্ঞানের গ্রন্থ নয় এবং পার্থিব উন্নতি অর্জন তার বিষয়বস্তুও নয়। কারণ এই বিষয়গুলো মানুষ নিজের চিন্তাভাবনা, গবেষণা, অভিজ্ঞতার মাধ্যমে উদঘাটন করতে পারবে। এজন্য আল্লাহ তাআলা এই বিষয়গুলো মানুষের মেধা ও পরিশ্রমের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। আর যে বিষয়গুলো নিছক মানুষের আকলের ওপর নির্ভরশীল হতে পারে না, বরং ওহির কোনো বিকল্প নেই ও ওহির দ্বারস্থ হতে হয়, সেগুলোকে নুসুসে শরিয়াহর বিষয়বস্তু বানিয়েছেন।
সুতরাং আমাদেরকে ওপরে উল্লেখিত বিভাজনটি বুঝে নুসুসে শরিয়া ও বিজ্ঞানের প্রতিটি দিককে স্ব স্ব স্থানে রেখে বিচার করতে হবে। লাগামহীনভাবে বিজ্ঞানকে ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর কিংবা লাগামহীনভাবে বিজ্ঞানের সকল কিছুকে ইসলামি বানানোর প্রচেষ্টা—উভয় প্রান্তিকতা থেকেই বেঁচে থাকতে হবে। সর্বোপরি নুসুসে শরিয়াহকে বিজ্ঞানের আলোকে নয়, সালাফে সালেহিনের ফাহম ও মানহাজ অনুযায়ীই বুঝতে হবে।
সিজদাহ পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিতব্য ফাহমুস সালাফ বইয়ের একটি অংশ।
- ইফতেখার সিফাত
Next Post Previous Post