বাঙালি কি মুসলিম না হিন্দু? বাঙ্গালী জাতির নামকরন করেছেন কে?

 বাঙলা ও বাঙালি নিয়ে আলাপ। এটা এক্টিভিস্ট আলাপ, একাডেমিক না। পূর্ববঙ্গের মুসলিমরা বাঙালি কিনা। বা সহীহ বাঙালি কিনা। এটা নিয়ে বেশ আলাপ জারি আছে শিক্ষিত মহলে। একটু মন-দেল দিয়ে পড়তে হবে।


এই জাতিসত্তার দুইটা ডাইমেনশন আছে।
এক. স্থানিক (এই এলাকায় বসবাসের দরুন আমরা বাঙালি)
দুই. ভাষা (বাংলায় কথা বলার দরুন আমরা বাঙালি)।

এক. স্থানিক বিবেচনায় বাঙালিত্ব:

প্রাচীনকালে এ অঞ্চলের কোনাে নির্দিষ্ট নাম ছিল না। বৃহৎ বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল বঙ্গ, পুণ্ড্র, রাঢ়, সূক্ষ, হরিকেল, সমতট, চন্দ্রদ্বীপ, তাম্রলিপ্তি, কামরূপ, বরেন্দ্র প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। এজন্য প্রাচীন বাংলার ম্যাপটা দেখা দরকার। কোন অংশটাকে বঙ্গ বলা হতো দেখুন। ভাগিরথীর পূর্বপাশ থেকে সম্মিলিত মেঘনার পশ্চিমপাশ পর্যন্ত যে নতুন গঠিত পলিভূমি, এটুকু বঙ্গ।

সপ্তম শতাব্দিতে এ এলাকার প্রথম স্বাধীন সার্বভৌম রাজা শশাংক এই জনপদ গুলিকে 'গৌড়' নামে একত্রিত করেন, নট বঙ্গ বা বাংলা। শশাঙ্কের আমলেও 'বঙ্গ'-এর বৃহত্তর কোনো কনসেপ্ট নেই। 'বাঙলা'র তো নেই-ই। সেখানে 'বঙ্গ' জমিনকে অন্তর্ভুক্ত করলেও বঙ্গ জাতিয়তা গঠন করে না। শশাঙ্ক নিজে ছিল মগধ (বিহার) এলাকার।

এর পর গৌড় সাম্রাজ্য আবার পুভ্র, গৌড় ও বঙ্গ এই তিন নামে বিভক্ত হয়ে যায়। লক্ষণ সেনের উপাধি ছিল 'গৌড়েশ্বর'। খলজীর আক্রমণের সময় তিনি নদীয়া-তে অবস্থান করছিলেন, বঙ্গ এলাকায়। রাজধানী ছিল লক্ষণাবতী (লখনৌতি)। তখনও বাঙলার জাতীয়তা কনসেপ্ট নেই।



মুসলমান আমলে এসব জনপদ আবার একত্রিত হয় এবং নাম হয় (বঙ্গ+ আল= বঙ্গাল> বাঙ্গাল> বাঙ্গালাহ) অর্থাৎ বাংলা অথবা বাঙালা নামের ধারণা সর্বপ্রথম তৈরিই হয় স্বাধীন সুলতানী আমলে। ইতিহাসবিদ আবুল ফজলের উদ্ধৃতি দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন,
"মুসলমান শাসনামলে বিশেষ করে ১৩৩৬ থেকে ১৫৭৬ সাল পর্যন্ত সুলতানি আমলে এবং ১৫৭৬ সালে মোঘলরা বাংলা দখল করার পরে এই অঞ্চলটি বাঙাল বা বাঙালাহ নামেই পরিচিতি পায়।"

ইলিয়াস শাহ-ই পয়লা 'শাহ-ই-বাঙ্গালাহ' উপাধি ধারন করেন৷তাই ইলিয়াস শাহের সময় থেকেই প্রথম ‘বাঙ্গালা’ তার ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এর আগে, এমনকি মুসলমান –পূর্ব যুগে, এই ব্যাপক অর্থে ‘বাংলা’ বা ‘বাঙ্গালা’র ব্যবহার পাওয়া যায় না। সুতরাং একথা নিঃসন্দেহে বলা চলা যে, ‘বাঙ্গালা’ বলতে সারা বাংলাকে অর্থাৎ আবুল ফজলের ‘বাঙ্গালা’ বা ইউরোপীয়দের ‘বেঙ্গালা’, ‘বেঙ্গল’ –কে যদি বুঝানো হয়, সে জাতীয়তা জন্ম নিয়েছেই স্বাধীন সুলতানী আমলে। মুসলিমদের হাতে।

শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলাও বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসামের মতো কয়েকটি প্রেসিডেন্সি নিয়ে নাম দিয়েছিলেন "বঙ্গ"। অর্থাৎ বঙ্গ ধারণার সার্বিকতা বজায় রেখেছেন।

১২০২ সালে তুর্কীরা এ অঞ্চলে প্রবেশ করে। বখতিয়ার খলজীর পর সেনা হিসেবে, সুফী হিসেবে বিপুল সংখ্যক বিদেশী মুসলমান ঢোকেন এ এলাকায়। সংখ্যা লক্ষ লক্ষ হবার সম্ভাবনাই অধিক। সময়ের সাথে সাথে যুক্ত হতে থাকে নিম্নবর্গের হিন্দু ও বৌদ্ধ কনভার্ট৷ সবচেয়ে বেশি যারা ছিল, তারা হল 'অনার্য অহিন্দু' যাযাবর সম্প্রদায় যারা নতুন পলিভূমিতে কৃষক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, জমি অধিগ্রহণ করে। (যাদের একটা অংশ আজ বেদে হিসেবে আমরা পাই)। যারা ইসলাম গ্রহণ করে।

শুধু হিন্দুদের হাতে বা শুধু ব্রাহ্মণদের সংস্কৃতিকে বড়জোর 'বঙ্গীয়' বা 'গৌড়ীয়' কালচার বলা যেতে পারে। 'বাঙালি' কালচার বলতে হলে আপনাকে স্বাধীন সুলতানী আমলে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের কালচারকেই বুঝতে হবে। কেননা এর আগে জাতীয়তা হিসেবে 'বাঙলা' 'বাঙালি' শব্দটা এবং কনসেপ্টটাই অনুপস্থিত।

উপনিবেশী শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় উচ্চ বর্ণহিন্দুরা বাঙালি শব্দটাকে ছিনতাই করে এমন এক অর্থ ও দর্শন দিয়েছে যা কলকাতার বর্ণহিন্দু কালচারকেই ধারণ করে। বাকি সবকিছুকে অবাঙালি সাব্যস্ত করে। হিন্দু ধর্মাচরণ ও আধ্যাত্মকে ধারণ করতে বলে। অথচ ঐ শব্দটাই তোমাদের নয়।

বাঙলা, বাঙালি শব্দগুলো মুসলমানদের। আমরাই এর হকদার। শরৎচন্দ্রের 'বাঙালি ও মুসলমান ছেলেদের ফুটবল খেলা' ভুল ও পরিচয় ছিনতাই। বরং কথাটা হবে 'হিন্দু ও বাঙ্গালি ছেলেদের' ফুটবল খেলা কিংবা 'বঙ্গীয় (হিন্দু) ও বাঙ্গালী (মুসলমান)' ছেলেদের ফুটবল খেলা।

'ভাষাগত বিবেচনায় বাঙালিত্ব' নিয়ে পরের আলাপ।
- Shamsul Arefin Shakti
Next Post Previous Post