কমনসেন্স - আসিফ আদনান

 লিবারেলদের একটা পছন্দের আরগুমেন্ট হল ‘কমনসেন্স’। এই আরগুমেন্ট তারা বিভিন্নভাবে ব্যবহার করে। মুসলিম ব্যাকগ্রাউন্ডের লিবারেলদের অনেককে যেমন বলতে দেখবেন–

.
"ইসলামের বিভিন্ন ব্যাখ্যা আছে। এই ব্যাখ্যগুলোর একটার আরেকটার সাথে সাংঘর্ষিকতা আছে। এছাড়া আধুনিক পৃথিবীর বিভিন্ন ধ্যানধারণার সাথেও অনেক কিছু মেলে না। তাই কুরআন-সুন্নাহতে যা আছে, আলিমদের যেসব বক্তব্য আছে, সব সরাসরি গ্রহণ করা যাবে না। কমনসেন্স ব্যবহার করতে হবে"।
.
অর্থাৎ– ইসলামের কোন দিক, কোন ব্যাখ্যা, কোন বিধান গ্রহণ বা বর্জন করা হবে সেটা কমনসেন্স দিয়ে বিচার করতে হবে। কমনসেন্স হল মাপকাঠি।
.
এই আরগুমেন্টের বড় বড় কিছু সমস্যা আছে। কয়েকটা দেখা যাক।
.
প্রথম প্রশ্ন হল, কমনসেন্স জিনিসটা কোথা থেকে আসছে? এটা কি আকাশ থেকে পড়ছে? মাটি ফুঁড়ে বের হচ্ছে? কমনসেন্স কি ধ্রুব, অপরিবর্তনীয় কিছু একটা? কমনসেন্স কি স্থান-কাল-পাত্রের প্রভাব থেকে মুক্ত? প্রত্যেক মানুষের মধ্যে কি এমন কোন অ্যালগরিদম আছে যেটা মানুষকে কিছু সুনির্দিষ্ট উপসংহারে পৌছে দিচ্ছে, যেগুলোকে আমরা কমনসেন্স বলছি?
.
আজ থেকে ১৫০ বছর আগেও এলজিটিভি-দের অসুস্থ, অনৈতিক ও বিকৃত মানসিকতার মানুষ মনে করা হতো। তখন এটাই কমনসেন্স আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল। আজকের কমনসেন্স বলে দুটো পুরুষ একে অপরকে ‘বিয়ে’ করবে, এটা স্রেফ অধিকারের প্রশ্ন।
.
একজন ছেলে কোন শারীরিক বাহ্যিক কারণ ছাড়া নিজেকে মেয়ে দাবি করছে, মেয়েদের পোশাক পড়ে ঘুরছে, বাকি সবার কাছে দাবি করছে তাকে মেয়ে বলে ট্রিট করার – এটাকে এক সময় জ্বিন বা জাদুর প্রভাব কিংবা ভয়ঙ্কর মানসিক অসুস্থতা মনে করা ছিল কমনসেন্স। এখন ‘পুরুষ আক্তার মহিলা’-কে মহিলা বলে ট্রিট করাই নাকি কমনসেন্সের দাবি।
.
‘কমনসেন্স’ আর 'কমনসেন্সের' উপসংহার সময়ের সাথে সাথে বদলায়। কমনসেন্স তৈরি হয় কিছু ফ্যাক্টরের প্রভাবে। আজকের পৃথিবীর বিরাট সংখ্যক মানুষের ‘কমনসেন্স’ যেমন তৈরি হয়েছে, সেক্যুলার শিক্ষা, সায়েন্টিফিক ন্যাচারালিসম, বস্তুবাদ, ম্যাস মিডিয়া এবং পারিপার্শ্বিকতার মাধ্যমে। এই ফ্যাক্টরগুলোকে নিয়ন্ত্রন করতে পারলে, মানুষের কমনসেন্সকে গড়ে নেয়া যায় একটা নির্দিষ্ট ছাঁচে।
.
এগুলো নতুন কথা না, ফ্রিডরিখ নিৎচা থেকে শুরু করে মার্ক্সিস্ট অ্যান্টনিও গ্র্যামশি, লুই আলথুসার, পাওলো ফ্রেরে, বিভিন্ন ডানপন্থী তাত্ত্বিক, দার্শনিকরা এই প্রভাবগুলো চিহ্নিত করেছে এগুলো নিয়ে আলোচনা করেছে।
.
নিজের স্বাধীন চিন্তা হিসেবে মনে করে অধিকাংশ মানুষ যেসব ধারণা আর মূল্যবোধকে আকড়ে রাখে তার অধিকাংশই অন্যের কাছ থেকে ধার করা চিন্তা। সে স্বাধীন, স্বতন্ত্রভাবে এই উপসংহারগুলোতে পৌছায়নি। মুন্সিয়ানার সাথে তার মাথায় এই চিন্তাগুলো বসানো হয়েছে।
.
কাজেই কমনসেন্স স্থান-কাল-পাত্রের প্রভাব মুক্ত না। কোন সময়ের ক্ষমতাসীনরা যেসব ধ্যানধারণার পৃষ্ঠপোষকতা করে, যেগুলো ডমিন্যান্ট ন্যারেটিভ অধিকাংশ মানুষ সেগুলোই গ্রহণ করে নেয়। এই সেন্স তাই আসলে 'কমন' বা সর্বজনীন না, বরং 'পার্টিকুলার' বা নির্দিষ্ট - যা তৈরি হয় নির্দিষ্ট সামাজিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে। এই ধরণের ‘কমনসেন্সের’ মাপকাঠিতে স্রষ্টার বিধানকে মাপা, নৈতিকতার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া নির্বুদ্ধিতা।
.
এই আরগুমেন্টের আরেকটা সমস্যা হল, এটা চক্রাকার যুক্তি প্রয়োগ করে। আধুনিক সেক্যুলার বিশ্বব্যবস্থা আমাদের মাথায় কিছু ধ্যানধারণা দিয়েছে। সেগুলো আমরা ‘কমনসেন্স’ হিসেবে সর্বজনীন মনে করে গ্রহণ করেছি। ইসলামের কোন অবস্থান যখন সেই সেক্যুলার ধারণার সাথে মিলছে না, তখন সেক্যুলার ধারণার মাপকাঠিতেই আমরা আবার ইসলামকে বদলাতে চাচ্ছি। কমনসেন্স আন্ডারস্ট্যান্ডিং-এর সাথে ইসলাম মিলে না, তাই কমনসেন্স দিয়ে ইসলাম মডিফাই করতে হবে – সার্কুলার রিসনিং।
.
চতুর্থ সমস্যা, লিবারেল-সেক্যুলাররা যেগুলোকে কমনসেন্স বলে, পৃথিবীর বিশালসংখ্যক মানুষ এখনো সেগুলোকে ‘কমন’ বা স্বাভাবিক মনে করে না। পৃথিবীর সব অঞ্চল এবং গোষ্ঠীর লোকেরা মনে করে, প্রত্যেক মানুষের নূন্যতম মৌলিক অধিকার আছে। কিন্তু এলজিটিভি হওয়া, কিংবা যিনা করতে পারাকে অধিকাংশ মানুষ মানবাধিকারের প্রশ্ন মনে করে না। দু’জন মানুষ নিজেদের আনন্দের জন্য সঙ্গম করবে। সন্তান পেটে আসলে ইচ্ছে হলে তাকে মেরে ফেলবে, এটা নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রশ্ন – এটা লিবারেলদের কমনসেন্সের উপসংহার। কিন্তু ইতিহাসের অধিকাংশ মানুষের কাছে এটা পাইকারী খুন এবং জঘন্য অপরাধ।
.
যদি বলা হয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে কমনসেন্সের ভিত্তিতে, তাহলে প্রশ্ন হবে – কার কমনসেন্স?
.
লিবারেল-সেক্যুলাররা মূলত তাদের বিশ্বাস আর মূল্যবোধগুলোকে বিভিন্ন সর্বজনীন শব্দ ব্যবহার করে চালিয়ে দেয়। ইসলামের কোন অবস্থানের পক্ষে বলার সময় একজন মুসলিম বলে – 'এটা আল্লাহর আদেশ', অথবা বলে, 'আমি বিশ্বাস করি আল্লাহ এটা বলেছেন'।
.
লিবারেলরা তাদের বিশ্বাসের পক্ষে কথা বলার সময় বলে – 'এটা কমনসেন্স', 'এটাই যৌক্তিক উপসংহার'। 'যেকোন মানুষ কমনসেন্স খাটিয়ে যৌক্তিক ভাবে চিন্তা করলে এই উপসংহারে পৌছাবে'।
.
সেক্যুলার-লিবারেলরা একটা ওয়ার্ল্ডভিউ অন্ধের মতো অনুসরণ করে। এর দাবি, ভিত্তি, উপসংহার –এগুলো নিয়ে সে প্রশ্ন করে না। প্রশ্ন তোলার কথাও তার মাথায় আসে না। ধর্মে বিশ্বাসী মানুষ জানে সে একটা ধর্মের অনুসরণ করছে। কিন্তু লিবারেলরা ধর্মের মতোই লিবারেল-সেক্যুলারিসমের অনুসরণ করে, কিন্তু বোঝেও না যে সে অন্ধ বিশ্বাসী। এই বাস্তবতা তাদের চোখে ধরা দেয় না। কালারব্লাইন্ড মানুষ যেমন রং দেখতে পায় না, লিবারেলরা তেমন নিজেদের বায়াস আর অন্ধ অনুসরণের বাস্তবতা দেখতে পায় না।
.
আর এ কারণেই সম্ভবত, তাদের ‘কমনসেন্স আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ বাকি পৃথিবীর ওপর চাপিয়ে দেয়ার জন্য এতো নির্লিপ্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে তারা ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারে।
Next Post Previous Post