ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তনই আমাদের একমাত্র উত্তরণের পথ। উস্তাদ আরজু আহমাদের কলাম।

 ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তনই আমাদের একমাত্র উত্তরণের পথ।উস্তাদ আরজু আহমাদের কলাম।



চারশো বছরের বৌদ্ধ শাসনের ইতি ঘটিয়ে দক্ষিণ ভারতীয় সেন রাজশক্তি বৃহৎ বাঙলা অঞ্চল দখলে নিলে বৌদ্ধরা ব্যাপক দলন-দমন ও হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়। কেউ কেউ পালিয়ে নেপাল, চীন চলে যায়।

কেউ কেউ বাধ্যতামূলক ধর্মান্তরিত হয়ে স্থান পায় শ্রেণিবাদী হিন্দুধর্মের সর্বাপেক্ষা নিম্নশ্রেণীতে। বাঙলা ভাষার সর্বপ্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদ নেপাল থেকে আবিষ্কৃত হওয়ার এটাই জানান দেয় যে 'বৌদ্ধধর্ম সংগীত' বুকে ধারণ করেই বাঙালি বৌদ্ধরা নেপলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল।

তদানীং হিন্দু রাজের যে অত্যাচারমূলক সাম্প্রদায়িক নীতি ছিল তাতে এ অঞ্চলের বৌদ্ধরা জাতিগত নিধনের শিকার হয়েছিল। আজো হয়ত নেপাল, মিয়ানমার, চীনের কোনও প্রান্তরে এই বাঙালি বৌদ্ধের অধঃস্তন উত্তরাধিকারের বাস রয়েছে৷

এই সময়কালেই মুসলমানদের ভারত বিজয়ে যে শান্তি ও সমৃদ্ধি কায়েম হয়েছিল, যে ধর্মীয় সহনশীলতা তৈরি হয়েছিল তা অবিজিত বৃহৎ বাঙলা, মগধ প্রভৃতি অঞ্চলের মানুষকে ব্যাপক আশান্বিত করেছিল। মগধ ছিল আধুনিক দক্ষিণ বিহার কেন্দ্রিক শক্তিশালী অঞ্চল।
একদল বৌদ্ধ মগধ অঞ্চল থেকে ইখতিয়ার উদ্দীন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির নিকট সেনদের নানাবিধ অত্যাচারের বিবরণ শুনিয়ে হিন্দুরাজের বিরুদ্ধে সুলতানের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন।

সুলতান তাঁর বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসেন এবং সেন বংশের রাজা লক্ষণ সেন কে পরাজিত করে ১২০৪ সালে বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা করেন।
তিব্বতি ঐতিহাসিক ও সর্বমান্য বৌদ্ধ পণ্ডিত কুলাচার্য জ্ঞানানশ্রী (Kulacharya Yanansri) তার ‘ভাদ্র কল্পদ্রুম’ (Bhadra Kalpadrum) গ্রন্থে বৌদ্ধদের পুনঃপুন সাহায্য প্রার্থনার কথা লিখেন।


ড. দীনেশ চন্দ্র সেন মুসলিম বিজয়ের দিকে ইঙ্গিত করে লিখেন-

"ইতিহাসে কোথাও একথা নাই যে সেনরাজত্বের ধ্বংসের প্রাক্কালে মুসলমানদিগের সঙ্গে বাঙালি জাতির রীতিমত কোনো যুদ্ধবিগ্রহ হইয়াছে। পরন্তু দেখা যায় যে বঙ্গবিজয়ের পরে বিশেষ করিয়া উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে সহস্র সহস্র বৌদ্ধ ও নিম্নশ্রেণীর হিন্দু, নব ব্রাহ্মণদিগের ঘোর অত্যাচার সহ্য করিতে না পারিয়া ইসলাম ধর্ম গ্রহণপূর্বক স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়াছে।"

চর্যাপদের আবিষ্কারক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেন, - 'একদিনেই বৌদ্ধদের অর্ধেক ইসলাম গ্রহণ করেন।'


যে জনপদে ইসলামের প্রবেশ ছিল মাজলুমের সুরক্ষায়, বৌদ্ধদের মুক্তিদানের জন্য সেই জনপদের মুসলমানদের সঙ্গে বৌদ্ধদের প্রতিদান আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর চালানো জাতিগত নিধন।

যে ভারতের বুকে ইসলামের বিজয়যাত্রার ভিত্তিমূল স্থাপিত হয়েছিল কয়েকজন মুসলিম বণিকের মৃত্যু আর বন্দী নারীর আর্তনাদ ঘোচাবার আহ্বানে। সে ভারতে ৮০০ বছরের মুসলিম শাসন দিয়েছে সমৃদ্ধি, যা কিছু মহান দিয়েছে তার সবই। মঙ্গলদের আক্রমণ থেকে চারবার ভারতকে সুরক্ষা দিয়েছে এই মুসলিমরাই।

সেই ৮০০ বছরে মুসলমান যদি চাইত তবে হিন্দু ধর্মের অস্তিত্ব নিঃশ্চিহ্ন হয়ে যেত। কোনও মন্দির উঁচু থাকতে পারত না। অথচ ভেকধারী সেক্যুলার ভারত এক দশমাংশেরও কম সময়ে ইসলাম ও মুসলমানদের বিপন্ন করে তুলেছে।

৮০০ বছরের ইতিহাসে হিন্দু ধর্মের উপর কোনও বিধিনিষেধ আসে নি। অথচ সেক্যুলার ভারত মাত্র ৭২ বছরে তার অধিকাংশ রাজ্যে কুরবানির অধিকার হরণ করেছে। কোরাআনি বিধানের মত বহু ধর্মীয় বিধানে হহস্তক্ষেপ করেছে। অসংখ্য হত্যা ও খুন জারি রেখেছে কেবল মুসলিম পরিচয়ের জন্য।

৬৩৭ সালে আল্লাহ্‌র রাসুল দুনিয়া থেকে বিদায় হওয়ার ৫ বছর অতিক্রান্ত । তখন উমার রা. মুসলিম দুনিয়ার সর্বাধিনায়ক। একে একে রোমানদের পরাজয় নিশ্চিত করে মুসলমানরা জেরুজালেম অবধি পৌঁছে গেল। অবরুদ্ধ করল শহরবাসীদের। ৪০ হাজার জানবাজ সাহাবা চাইলেই কেবল তলোয়ারের আঘাতে জেরুজালেমের কতৃত্ব নিতে পারতেন।

কিন্তু না, মুসলমান রক্তপাত এড়িয়ে গেল। খোদ খলিফা উমার লিখিত অধ্যাদেশে সমস্ত খ্রিস্টানদের নিরাপত্তা দেন। গীর্জাসমূহকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হল।

১৩৫ খ্রিস্টাব্দে জেরুজালেমে খ্রিস্টশক্তি হিসেবে রোমান সম্রাট হাদ্রিয়ানের বিজয়ের পর জেরুজালেমে ইহুদিদের উপর গণহত্যা চালানো হয়েছিল তাদের নিষিদ্ধ করা হয়েছিল জেরুজালেমে।

শত শত বছর পর এই প্রথম ইহুদিরা জেরুজালেমে বসবাস ও ধর্মপালনের স্বাধীনতা পেয়েছিল সেদিন। শহরের বাইরে উদ্বাস্তু ৭০ টি ইহুদি পরিবারকে তড়িৎ ইসলামি প্রশাসন নগরে বসবাসের সুযোগ করে দিয়েছিল।

এই ৫০০ বছর খ্রিস্ট শাসনের অবসানের পর ইসলামি শাসনের অধীন ইহুদিরা জেরুজালেমে আবার প্রবেশাধিকার পায়। নিরাপত্তা লাভ করে। এই প্রথম নিজেদের তীর্থস্থান ভ্রমণের সুযোগ পায় বিশ্বের ইহুদিরা।

অথচ এই ইহুদি, খ্রিস্টানেরা সম্মিলিতভাবেই সেই জেরুজালেম থেকে মুসলমানদের বাস্তুচ্যুত করেছে। পবিত্রভূমিকে রক্তস্নাত করেছে বহু লাখো মুসলমান নারী, শিশু ও যুবকের রক্তে।

আজকের যে নগর ইউরোপ, সেই ইউরোপকে নগরজ্ঞানে সমৃদ্ধ করেছে যে মুসলিম স্পেন। যে জ্ঞান ও বিজ্ঞানের ভিত্তি দান করেছে মুসলমানের দাঁড় করানো মহাকাশবিজ্ঞান, আলোকবিদ্যা, সার্জারি সায়েন্স, এলগরিদম, বীজগণিত, পদার্থ বিজ্ঞান, ক্রিস্টাল থেকে কাঁচের সৃষ্টি যাদের হাত ধরে।

যে দিকনির্ণয় যন্ত্রের সৃষ্টি মুসলমানের হাতে- সমুদ্র নির্ভর ইউরোপের এর প্রতি কতখানি ঋণ তা আজ দেদার অস্বীকার করে যাওয়া সে নেমকহারাম সভ্যতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমরা।
ওরা আমাদেরকে আমাদের ভূমিতে মারবে, নিজেদের ভূমিতে মারবে যখন যেখানে ইচ্ছে মারবে। তারা ইরাক মিথ্যে অস্ত্রের অজুহাতে হামলা করে নিঃশ্চিহ্ন করে গেল। লিবিয়ায় স্বৈরতন্ত্র থেকে সুশাসন এনে দেবে বলে জাহান্নাম বানিয়ে দিয়ে গেল।
আফগানিস্তানের তালেবান সরকারকে অমানবিক আখ্যা দিয়ে কুন্দুযে বিমান হামলা চালিয়ে হেফজখানার ৮০ জন শিশু হুফফাযে কেরামের হত্যার মত গণহত্যাকেও বৈধতা দিয়ে গেল।

অথচ এই হামলার প্রতিরোধ গড়লে হয়ে যাবে জঙ্গি, সন্ত্রাসী। আর তারা হামলা চালালে সেটা শান্তি প্রতিষ্ঠা। কাশ্মীর থেকে দূর আফ্রিকার মালি, মুসলমান প্রতিরোধ করলেই তারা নির্বিচার জঙ্গি ও সন্ত্রাসী।

আর এর সাথে সাথেই যাবতীয় খুন ও অবিচারের বৈধতা হাজির হয়। সে মুসলমান কেবল এই পরিচয়ের জন্যই সে জগতজোড়া মার খেয়ে যাচ্ছে।
আর এটা আমরাও বুঝি৷ তাই আমরা মডারেট হবার নাম করে প্রাত্যহিক বিকিয়ে দিই নিজেদের। আমরা মনে করি আমাদের এই সংশোধনবাদ তাদেরকে সন্তুষ্ট করবে? কখনোই না।

আল্লাহ তো সূরা নিসায় বলেই দিয়েছেন, ততক্ষণ অবধি তারা তৃপ্ত হবে না যতক্ষণ না আমরাও তাদের ধর্মকে গ্রহণ করব।

বিপরীতে তাদেরকে তুষ্ট করার আমাদের এই নীতি আল্লাহকে রুষ্ট করে। যার ফল আমাদের এই পরাজয়। আল্লাহ সুরা আল ইমরানে আমাদের সাবধান করে দিয়ে বলছেন , যদি তোমরা তাদের অনুগত হয়ে যাও, তাহলে তারা তোমাদের পশ্চাতে নিয়ে যাবে। আর এর ফলস্বরূপ তোমরা হবে অপমানিত, পরাজিত, অপদস্ত আর ক্ষতিগ্রস্ত।

অপরদিকে সূরা ইমরানের ১৩৯ তম আয়াতে এর সমাধান বাতলে দিয়ে বলছেন, আর তোমরা নিরাশ হয়ো না, ভয় পেয়ো না, দুঃখ কোরো না। বিজয়ী তোমরাই হবে। তবে একশর্তে 'যদি তোমরা মুমিন হও'।

মহান আল্লাহ আমাদেরকে মুমিন হওয়ার তাওফিক দিন। উম্মতের এই দুর্দশা কেবল ঈমানের বলই মোকাবিলা করতে সক্ষম। সে বল আমাদের তৈরি হোক।
ইসলামি শরিয়াত, তাহজিব, তামাদ্দুনের প্রতি আমাদের যে হীনমন্যতা, মুসলিম হিসেবে নিজেকে সঙ্কটাপন্ন ভাবার যে প্রবণতা এর থেকে আমাদের বেরুতে হবে। ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তনই আমাদের একমাত্র উত্তরণের পথ।
উস্তাদ আরজু আহমাদের কলাম।
Next Post Previous Post