১৩৪৮ খ্রিষ্টাব্দ। ৭৪৮ হিজরি সনের সিরিয়ার মহামারি 'তাউনে আজম' বা 'বড় মহামারি | Ainul Haque Qasimi

১৩৪৮ খ্রিষ্টাব্দ। ৭৪৮ হিজরি সনের সিরিয়ার মহামারি 'তাউনে আজম' বা 'বড় মহামারি 




১৩৪৮ খ্রিষ্টাব্দ। ৭৪৮ হিজরি।
মামলুক সালতানাতের সিংহাসনে তখন সুলতান আল-মালিক আন-নাসির হাসান কালাউন (১৩৪৮-১৩৫১) সমাসীন। সেই সময় গোটা শামে মহামারি দেখা দেয়। মহামারির বিস্তৃতি ও ক্ষয়ক্ষতির কারণে মহামারির নাম 'তাউনে আজম' বা 'বড় মহামারি' পড়ে যায়! শামের আলেপ্পো, দামেশক, জেরুজালেম ও উপকূলীয় অঞ্চলে মহামারির প্রকোপ ছিল মারাত্মক।

শুধুমাত্র আলেপ্পো ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলো থেকে প্রায় দেড়লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল এই মহামারি! এতবেশি মানুষ মারা গিয়েছিল যে, রাস্তাঘাটে ও ঘরবাড়িতে তিনদিন পর্যন্ত লাশ পড়ে রইত, সংক্রমণের ভয়ে কেউ ছুঁয়েও ধরত না! কাফন-দাফন তো দূর কি বাত! 

মহামারির মরণকামড় থেকে জনগণকে বাঁচাতে মামলুক সুলতান, উজির, নাজির ও ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ শামের স্থানে স্থানে গড়ে তুলেছিলেন 'বিমারিস্তান' বা হাসপাতাল। বিমারিস্তানগুলোতে অত্যন্ত যত্নসহকারে মহামারিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও পর্যবেক্ষণ করা হতো। 

শুধু তাই নয়; মহামারিতে মৃত লাশের গোসল দেওয়ার জন্য সরকারিভাবে তারা প্রচুর 'হানুত' বা গোসলখানাও তৈরি করেছিলেন। যেহেতু এসব লাশ কেউ ছুঁয়েও ধরত না। এসব গোসলখানায় থাকত বেতনভোগী কর্মচারী। যারা লাশের গোসল ও কাফন-দাফনের কাজ আঞ্জাম দিত। স্বাভাবিকভাবে মৃত গরিব মুসলমানদেরও এখানে গোসল ও কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করা হতো। 

কঠিন এই মুহূর্তে সালতানাতের বুজুর্গ, দরবেশ ও উলামায়ে কেরাম জনসাধারণকে আল্লাহ তাআলার নৈকট্যলাভ করার সবক দিতে থাকেন। তাদের ওয়াজে উদ্বুদ্ধ হয়ে লোকেরা ইবাদত-বন্দেগি, তিলাওয়াত, দুআ-কালাম ও কান্নাকাটি করতে থাকে। সুস্থতার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাগ্রহণের পাশাপাশি আল্লাহমুখি হতে শুরু করে। 

মামলুক প্রশাসকগণ মদ্যশালা ও আমোদপ্রমোদের জায়গাগুলো বন্ধ করার আইন জারি করেন। লোকেরা আল্লাহর নাফরমানি থেকে বিরত থাকতে শুরু করে। বেশি বেশি আমল করতে প্রয়াসী হয়। এভাবেই একসময় মহামারির প্রাদুর্ভাব শেষ হয়ে যায়। মামলুক সালতানাত এই কঠিন বিপদ কাটিয়ে উঠে। 

পুনশ্চ : মহামারির প্রকোপ থেকে বাঁচতে, স্বাস্থ্যরক্ষার প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাগ্রহণের পাশাপাশি আল্লাহমুখি হতে হয়। এটার নামই তাওয়াক্কুল। ব্যবস্থাগ্রহণ ছাড়া আল্লাহকে ডাকা তাওয়াক্কুল নয়। মামলুক সালতানাতের আমলে সংঘটিত মহামারির ইতিহাস থেকে আমাদেরও শিক্ষা নেওয়ার আছে। 
__________
সূত্র : আল-আওবিআহ ওয়া আসারুহাল ইজতিমাইয়্যাহ ফি বিলাদিশ শাম ফিল আসরিল মামালিকিশ শারাকিসাহ : ৪৮-৫৭, মুবারক মুহাম্মদ আত-তারাবিনাহ।









---

১৮৩১ সালের ১৫ ই জুন। 
কুয়েত জুড়ে দেখা দেয় মরণঘাতী মহামারি–প্লেগ। তখন কুয়েতের শাসক ছিলেন জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ আস-সাব্বাহ। মহামারির উৎপত্তি ছিল আরব উপদ্বীপে। সেখান থেকে ছড়ায় কুয়েতে। মাত্র কয়েকমাস স্থায়ী ছিল মহামারি। কিন্তু এরই মধ্যে মারা যায় কুয়েতের অর্ধেকের চেয়েও বেশি মানুষ। প্রায় ১০ হাজার। বেশিরভাগই ছিল নারী ও শিশু। মহামারির ছোবল থেকে বাঁচতে অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে শুয়াইখ নামক অঞ্চলে গিয়ে খড়ের ঝুপড়ি বানিয়ে বসবাস করতে থাকে। 

প্রসিদ্ধ ইংরেজ পর্যটক স্টকলারের মতে, মহামারির পর কুয়েতে বেঁচে যাওয়া লোকের সংখ্যা ছিল মাত্র চারহাজার! মহামারিতে পুরো কুয়েত হয়ে যায় মৃত্যুপুরী। জনসংখ্যার সংকট দেখা দেয়। আর দুর্ভিক্ষ তো ছিলই। কোনো কোনো পরিবারের সব সদস্য মরে সাফ হয়ে যায়। বংশপ্রদীপ জ্বলার মতোও কেউ বেঁচে ছিল না। মহামারির প্রকোপ চলে যাওয়ার পর দেখা যায়, গোটা কুয়েত একটা গোরস্তানে পরিণত হয়েছে। আবার অনেককেই দাফন করা হয়ছে ঘরের মধ্যে গর্ত খুঁড়ে।

চলে যায় মহামারি। কুয়েতের পরিবেশ আস্তে আস্তে হয় স্বচ্ছ ও নির্মল হতে শুরু করে। শীতের পর যেভাবে বসন্তকালে প্রকৃতি সজীব হয়ে উঠে, কুয়েতের প্রকৃতি ও পরিবেশ সেভাবেই আগের মতো হতে লাগল। দেশের বাইরে থাকা মুসাফির ও বণিকরা এসে নতুন করে আবাদ করতে লাগল। মহামারির প্রকোপ থেকে যারা বেঁচে গেল, তাদেরকে শারক নামক অঞ্চলের একটি কেল্লায় পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য মজুদ করে দিয়ে, কিছুদিন আবদ্ধ করে রাখা হলো। যাতে করে তাদের থেকে আবারও মহামারির ভাইরাস না ছড়ায়। 

শারক অঞ্চলে বসবাস করত একটি একান্নবর্তী পরিবার। বড় পরিবার হিসেবে সে অঞ্চলে তাদের আলাদা একটা নামধাম ছিল। মহামারি দেখা দিতেই তারা এমনভাবে গৃহাভ্যন্তর জীবন যাপন করতে লাগল, যা ইতিহাসে বিরল। তাদের জনবিচ্ছিন্নতার এই অভিনব পদ্ধতি-অবলম্বন দেখলে সত্যিই অবাক হতে হয়। মহামারি দেখা দিতেই তারা দীর্ঘদিনের জন্য খাদ্য মজুদ করে ঘরে আবদ্ধ হয়ে রইল। এমনকী কেউ যাতে বের হতে না পারে, সেজন্য ঘরের দরজা-খিড়কি ভেঙে সেখানে মাটি দিয়ে লেপন করে নিল। পুরো ঘর দেয়ালবেষ্টিত; কোথাও কোনো দরজা নেই! নেই কোনো খিড়কি! 

এহেন পরিস্থিতিতে ঘরের একজন পুত্রবধূ ব্যতিক্রম কাজ করে বসে। সে বাপের বাড়ির লোকজনের অবস্থা জানতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। গৃহকর্তার বিধিনিষেধ মোটেও কানে উঠায়নি সে। অবশ্য পুনরায় ঘরে ফিরে না আসার শর্তে তাকে ক্ষমাও করে দেওয়া হয়। তাজ্জবের বিষয় যে, মহামারির প্রকোপ চলে যাওয়ার পর যখন দেখা গেল, পুরো কুয়েত মৃত্যুপুরী; তখন সম্পূর্ণ সুস্থ ও নিরাপদ ছিল ওই বড় পরিবারটি। তাদের কোনো সদস্য মারা যায়নি। মারা গিয়েছিল শুধুমাত্র একজন। আর সে হলো ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া সেই পুত্রবধূ! 

পুনশ্চ : ইতিহাসটা সম্পূর্ণ হোম কোয়ারেন্টাইন-সংক্রান্ত। বেশিদিন আগের নয়; মাত্র দুশো বছর আগের। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়। তবে কেউ সবক নেয়; আবার কেউ নেয় না। আমি-আপনি হয়তো না-নেওয়াদের দলে! 

[কুয়েতের প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক আবদুল আজিজ আর-রাশিদ কর্তৃক লিখিত 'তারিখু কুয়াইত'-এর বরাতে আমার লিখিত 'মহামারি' নামক অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি থেকে]
Next Post Previous Post