মা । মা দিবস এ বিশ্বনবী রাসুল ﷺ এঁর মাতৃভক্তির কথা ও আমাদের জন্য শিক্ষা

বিশ্ব মা দিবস বা মাদার ডে । আম্মা আম্মু মা 

মক্কার অভিজাত পরিবারের রীতি ছিল, তাদের সন্তানদের নিজেদের মায়েদের দুধ পান করানো হত না। জন্মের কিছুকাল পর ধাত্রীবিদ্যায় পারদর্শী বেদুঈনদের কাছে তুলে দেওয়া হত।

যাতে তারা শহরের দূষণযুক্ত পরিবেশের বদলে প্রান্তরের সবুজে বেড়ে উঠে। মক্কা অনুর্বর ছিল। ফলে তাজা ফসলের অভাব ছিল। প্রান্তরে তা ছিল সহজলভ্য।

সেখানকার পশুরা কচি ঘাস পেত ফলে সেগুলোও ছিল দুগ্ধবতী। বেদুইনদের ভাষাও ছিল সমৃদ্ধ। তাছাড়া মক্কায় বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রচুর লোক সমাগম হত। সংক্রমাক ব্যাধিতে শিশু মৃত্যু হার অধিক ছিল। তাই শহর থেকে শিশুদের দূরে রাখা হত।

ফলত শিশুকে সুস্বাস্থের অধিকারী করে গড়ে তুলতে- একইসঙ্গে বেদুইন জীবনের সংস্পর্শে সাহসী স্বভাব আর সুন্দর ভাষার শিক্ষা দিতে তারা বাচ্চাদের বেদুইনদের হাতে তুলে দিত।

রাসুল ﷺ এঁর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি জন্মগ্রহণের পর প্রথমে নিজের মাতৃদুগ্ধ পান করেন। 

দ্বিতীয় নারী হিসেবে ছুয়াইবা এই সম্মান লাভ করেন। ছুয়াইবা ছিলেন আবু লাহাবের দাসী। আবু লাহাব তাঁকে স্বাধীন করে দেন।

এরপর থেকে তিনি হালিমার কাছে লালিতপালিত হন। বেদুইনদের সেই কাফেলার প্রত্যেকেই শিশু মোহাম্মদ ﷺ ইয়াতিম জানতে পেরে ফিরে যাচ্ছিলেন।

কারণ তারা মূলত এই আশায় শিশুদের নিয়ে যেতেন যেন শিশুকে ফেরত দেবার সময় অধিক উপঢৌকন পেতে পারেন। কিন্তু মোহাম্মদ ﷺ ছিলেন পিতৃহীন।

এটা স্বাভাবিক তাঁর জন্য অধিক খরচ করার কেউ ছিল না। কিন্তু মক্কায় পৌঁছুতে বিলম্ব হওয়ায় আর কোনও শিশুকে হালিমা রা. খুঁজে পাচ্ছিলেন না। খালি হাতে ফিরে যাবার চে' বরং তাঁরা মোহাম্মদ ﷺ কে গ্রহণ করেন।

হালিমা রা. তাঁর স্বামীকে বলেছিলেন, 'এমনও তো হতে পারে এই ইয়াতিম শিশুর মাধ্যমে আল্লাহ্‌ আমাদের কল্যাণ প্রদান করবেন।'

 এই বক্তব্য থেকে বুঝা যায়, তাঁরা মূলত উন্নত মননের অধিকারী ছিলেন। ইয়াতীমের প্রতি দয়াদ্র ছিলেন।

আর হয়েছিলও তাই। রাসুল ﷺ এঁর বরকত তাঁদের পরিবারকে এত সমৃদ্ধ করেছিল যে, তাঁরা তাদের গোত্রের সবচে' স্বচ্ছল পরিবারে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁদের পশুগুলো প্রচুর পরিমাণে পশম, দুধ ও বাচ্চা দিত।

হালিমা রা. এর পরিবার এত সন্তুষ্ট হন যে, তাদের অন্তরে উপঢৌকন লাভের আর কোনও আকাঙখাই ছিল না। 

চার বছর বয়সে তাঁরা রাসুল ﷺ কে তাঁর মা আমিনার কাছে ফেরত দিয়ে আসেন।

আদতে এত দীর্ঘ সময় ধরে বাচ্চা প্রতিপালনের রীতি ছিল না। কিন্তু যখনই কিছু দিন পর পর মুহাম্মদ ﷺ কে তাঁর মায়ের কাছে সাক্ষাত করতে নিয়ে আসতেন- নানা অজুহাতে পুনঃপুন অনুরোধ করে হালিমা রা সময় বৃদ্ধি করে নিতেন।

তিনি বালক মুহাম্মদ ﷺ এঁর প্রতি অত্যধিক স্নেহ পরবশ হয়ে পড়েছিলেন। নিজ মায়ের কাছে ফেরত আসার মাত্র দুছরের মধ্যেই, সেই শৈশবেই মোহাম্মদ ﷺ তাঁর মাকে হারান। ফলত মায়ের স্নেহবঞ্চিতই রইলেন তিনি।

আমেনার আযাদকৃত দাসী উম্মে আয়মান এরপর থেকে নবী ﷺ কে মাতৃস্নেহে বড়ো করেন। আমৃত্যু তিনি সেই স্নেহ করে গেছেন। খাদিজা রা. এঁর সঙ্গে বিয়ের সময়েও তিনি মায়ের সেই ভূমিকা পালন করেছেন।

এমনকি খাদিজা রা. এঁর সাথে রাসুল ﷺ এঁর বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার আগে নিজে কোনও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন নি। ‌এতটাই স্নেহ করতেন তিনি। সমস্ত যুদ্ধে রাসুল ﷺ এঁর পাশে ছিলেন তিনি। আহা, মা!

পরিণত বয়সে স্বীয় মাতৃসেবার কোনও সুযোগ ﷺ এঁর জন্য ছিল না। কিন্তু তিনি তাঁর বাকি তিন দুধমাতা ছুয়াইবা এবং হালিমা, উম্মে আয়মান রা. কে কখনোই ভুলেন নি।

ছুয়াইবা রা. দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছিল, দুগ্ধপানের বিনিময় হিসেবে এটা ছিল অনেক বেশি। তবুও রাসুল ﷺ তাঁর সম্মান করতেন। অর্থ ও বস্ত্র হাদিয়া হিসেবে প্রেরণ করতেন নিয়মিত। খোঁজ রাখতেন। প্রয়োজন পূরণ করতেন।

তাঁর প্রথমা স্ত্রী খাদিজা রা. নিজে আরবের সবচে' সম্ভ্রান্ত ও ধনী মহিলা হয়েও একজন আজাদকৃত সেই দাসীর খিদমতে হাজির হতেন। ছুয়াইবা রা. মারা যান ৭ ম হিজরিতে। তাঁর পুত্র তাঁর আগেই মারা যান।

তাঁর মৃত্যুতে রাসুল ﷺ ব্যথিত হন। খোঁজ করতে তাঁর আর কোনও স্বজন আছে কি না। যাতে এই মাতৃসুলভ সম্পর্কের স্বীকৃতি তিনি বজায় রাখতে পারেন। যদিও তাঁর আর কোনও আত্মীয় খুঁজে পাওয়া যায় নি।

উম্মে আয়মান রা. কেও আযাদ করা হয়েছিল। আর রাসুল ﷺ তাঁকে নিজের মা বলতেন। এমনকি একবার 'একমাত্র অবশিষ্ট পরিবার' বলেও অভহিত করেছিলেন। রাসুল ﷺ তাঁর যাবতীয় উপার্জনের একটা অংশ তাঁর খিদমতে পেশ করতেন।

রাসুল ﷺ তাঁর আরেক দুধমাতা হালিমাকেও কখনো ভুলেন নি। সুযোগ পেলেই তাঁর খিদমত করেছেলো। একবার যখন সমগ্র আরবে দুর্ভিক্ষে মুখোমুখি হলো।

হালিমা তখন মক্কায় আসলেন, যুবক মোহাম্মদ ﷺ নিজের স্বচ্ছলতা না থাকা স্বত্ত্বেও তাঁকে চল্লিশটা বকরী ও একটা উটনী প্রদান করেন।

তাঁর নবুওয়তকালে হালিমা রা. যখনই তাঁর কাছে আসতেন রাসুল ﷺ নিজ দরবার থেকে উঠে দাঁড়াতেন, এগিয়ে আনতে যেতেন আর বলতে থাকতেন থাকতেন, 'আমার আম্মা, আমার আম্মা…'।

নিজে হাত ধরে তাঁকে ভেতরে আনতেন। নিজের গায়ের মোবারক চাদর বিছিয়ে দিয়ে এর উপর বসতে দিতেন। হুনায়ুনের যুদ্ধে হাওয়াযিন গোত্রের এক হাজার যুদ্ধবন্দীকে বিনা মুক্তিপণে রাসুল ﷺ ক্ষমা করে দেন।

কেবল হালিমা রা. এর সাথে এই গোত্রের সম্পর্কের সম্মানে। অথচ তিনি চাইলে লক্ষ লক্ষ মুদ্রা মুক্তিপণ হিসেবে আদায় করতে পারতেন। কিন্তু দুধ মাতার সম্মানে সেসব ত্যাগ করেছেন। উম্মতকে শিখিয়েছেন।

তাঁর নিজের মা বেঁচে ছিলেন না, দুধমাতাকে সম্মান করে উম্মতকে শিক্ষা দিয়েছেন মাতৃসম্মান কেমন করে প্রদর্শন করতে হয়। রাসুল ﷺ নিজের গায়ের জামা খুলে দুধমাতাকে বসতে দিয়েছেন। 

আমরা আমাদের মায়েদের কতখানি সম্মান করি?

রাসুল ﷺ নিজের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত হাজারো বন্দি শত্রুকে বিনা মুক্তিপণে ক্ষমা করে শিখিয়েছেন- আমাদের পেশাগত, অর্থনৈতিক, ব্যবসায়িক ব্যস্ততা, টাকাকড়ির নেশা যেন মায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে বাঁধা না হয়ে দাঁড়ায়।

যেন মাকে সময় দেওয়ার অযুহাত হয়ে না উঠে এসব। মায়ের সেবা গ্রহণ করা নয় বরং আমরা তাঁর সেবা করব। আমাদের কাপড় আমাদের মায়েরা কেন কাঁচবেন? বরং আমরা তাঁর কাপড় কাঁচব৷ তাঁর পাতে ভাত তুলে দেব, মুখে তুলে দেব।

রাসুল ﷺ তো আসমান ও জমিনে সমস্ত সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ হওয়া স্বত্ত্বেও নিজের দুগ্ধমাতাকে নিজের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁর থেকে বেশি আর কাউকে সম্মান করেন নি।

আমাদেরকেও শিক্ষা দিয়েছেন, এই আল্লাহর আরশের নীচে মায়ের থেকে বেশি সম্মান আর ইজ্জত কারো পাবার অধিকার নেই। 

কেবলই দিবসী উদযাপন নয়- বরং যাপনের জীবনে মায়েরা থাকুন যথাযথ স্থানে।

আমার নেতা, আমার প্রধানমন্ত্রী, আমার রাষ্ট্রপতি, আমার অফিসের বস, আমার শায়েখ তাদের প্রত্যেকের চেয়ে বেশি সম্মানিত আমার মা।

মা থাকবেন ব্যক্তিগত ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে সবার উপরে৷ এটা সেই প্রিসিডেন্স যা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল ﷺ আমাদের জন্য প্রণয়ন করে গেছেন।

তাই মায়েদের, জগতের সব নারীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই। ইবনুল ক্বাইয়্যিম রহ. বলতেন, 'নারীরা পৃথিবীর অর্ধেক। বাকি অর্ধেকের জন্মও তাঁরাই দেন। ফলত যেন তাঁরাই সমগ্র পৃথিবী।'


Arju Ahmad



সুয়ায়বা ছিলেন আবু লাহাবের দাসী। রাসূল ﷺ-ভূমিষ্ঠ হলে তিনিই প্রথম আবু লাহাবের কাছে সংবাদ নিয়ে যান। আবু লাহাব ভাতিজার জন্মগ্রহণের খবর পেয়ে খুবই খুশি হল। সে তার দাসী সুয়ায়বাকে আজাদ করে দিয়ে বলে, "যাও, আমার ভাতিজার দেখভাল করো।"

এর বিনিময় আল্লাহ তাকে দিয়েছেন। সুয়ায়বালে মুক্ত করে রাসূল ﷺ-এর প্রতিপালনে নিযুক্ত করায় জাহান্নামে তাকে এক আঙুল পরিমাণ পানি পান করানো হয়। কারণ সে একটি আঙুলের ইশারায় তাঁকে আজাদ করেছিল। আবার সে সুয়ায়বাকে সোমবারে আজাদ করেছিল বিধায় প্রতি সোমবারে তার শাস্তি লাঘব করা হয়।

সুয়ায়বা রাসূল ﷺ-কে তিনদিন পর থেকে নিজের ছেলে মাসরুহর সাথে দুধ পান করান। সুয়ায়বার দুধ পান করেছেন হযরত হামজা এবং আবু সালামাহ রাদি.। তাঁরা দুজনই রাসূল ﷺ দুধ সম্পর্কীয় ভাই। যদিও রক্ত সম্পর্কের দিক দিক হযরত হামজা রাদি. হলেন চাচা।

মক্কাতে অবস্থানকালে রাসূল ﷺ সুয়ায়বার খোঁজখবর নিতেন। তাঁর সব প্রয়োজন তিনি মিটাতে চেষ্টা করতেন। মায়ের সম্মান দিতেন। হযরত খাদিজা রা.-সাথে বিবাহ বন্ধনের পর স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে সুয়ায়বার খবর রাখতেন। হযরত খাদিজা রা. তাঁকে শাশুড়ির ন্যায় আচরণ করতেন। মদিনাতে হিজরতের পরও তাঁর জন্য খাবার-কাপড় পাঠিয়ে দিতেন। সপ্তম হিজরিতে খায়বার যুদ্ধ থেকে ফেরার পর রাসূল ﷺ দুধ মা সুয়ায়বার মৃত্যু সংবাদ শুনে দুঃখিত হন। তারপর তাঁর ছেলে মাসরুহর খোঁজখবর নিতেন।

হযরত হালিমা রা. তাঁকে দুধ পান করান কয়েক বছর। তাঁর প্রতি রাসূল ﷺ-এর মুহাব্বতও ছিল প্রগাঢ়। তিনি হালিমা রা.-কে 'প্রিয় মা' বলে সম্বোধন করতেন। ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শনে ছিলেন উদার। নিজের গায়ের কম্বল বিছিয়ে দুধ মাতাকে বসতে দিতেন। মা ডাক দিলে দৌড়ে গিয়ে সাড়া দিতেন।

রাসূল ﷺ-এর বিয়ের পর একদিন হালিমা রা. মক্কায় দুধ সম্পর্কীয় সন্তানকে দেখতে আসলেন। তিনি বেশ কয়েকদিন হযরত খাদিজার রা. সান্নিধ্যে শাশুড়ির মর্যাদায় ছিলেন। তখন মদিনাতে ভয়ানক এক দুর্ভিক্ষ চলছিল। সেই দুর্ভিক্ষের ফলে হযরত হালিমা রা. আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। মারাত্মক অভাব দেখা দেয়। বেড়ানো শেষে মদিনাতে ফিরে যাওয়ার কালে হযরত খাদিজা রা. তাঁকে ৪০ টি ভেড়া এবং একটি উট উপহার দেন।

মক্কা বিজয়ের দিন হযরত হালিমা রা.-এর বোন—যিনি আবতাহে অবস্থান করছিলেন—চামড়ার থলেতে করে রাসূল ﷺ-এর জন্য মাখন ও পনির নিয়ে আসলেন। রাসূল ﷺ তাঁকে দেখে উৎসাহী হয়ে প্রথমই জিজ্ঞেস করলেন, "আমাদ দুধ মা কেমন আছেন?"

যখন জানানো হল, তিনি আর বেঁচে নেই তখন রাসূল ﷺ-এর দুটো চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে যায়। মা হারার ব্যথায় ব্যথাতুর ছিলেন তিনি।

রাসূল ﷺ-দুধ খালার বিদায় কালে হাদিয়া হিসাবে তাঁকে কিছু কাপড়চোপড়, একটি উট এবং ২০০ দিরহাম হাতে তুলে দেন।

যাওয়ার কালে তিনি বললেন, "তুমি আগের মতোই বিশ্বস্ত এবং প্রেমময় আছো।"

এ ছিল দুধ মাতা এবং তাঁদের আত্মীয়স্বজনদের প্রতি রাসূল ﷺ-এর ভালোবাসা এবং দায়িত্ববোধ। এবার সেই আয়ানায় নিজেদেরকে দেখে নিই। ত্রুটি থাকলে এখনই সংশোধন করে নিই। রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বায়ানি সাগীরা।

- Nazrul Islam 
Next Post Previous Post