মুসলিম কিন্তু পূজামণ্ডপ উদ্বোধন করে বেড়ায় এমন মুসলিমের আসল কাহিনি কি?

 অনেকের কাছে পূজামণ্ডপ উদ্বোধনকে খুব বড় কোন ব্যাপার মনে হয় না:


- ‘এটা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রকাশভঙ্গি। এগুলো নিয়ে বেশি হইচই
করা সাম্প্রদায়িকতা লক্ষণ।’
- ‘ইসলাম আমাদের উদার হতে শিক্ষা দেয়। মুসলিমদের আরো উদার
হওয়া উচিৎ।’
- ‘উদ্বোধন করা মানে তো পূজা করা না। ঈমান কি এতো ঠুনকো যে
এতোটুকুতে ভেঙ্গে যাবে...’
.
.
অনেকের কাছে নবী ﷺ-এর অবমাননাকে গুরুতর বিষয় মনে হয় না:
.
- ‘আমি এটা সমর্থন করি না। কিন্তু দেশের আইন অনুযায়ী এটা বৈধ।
আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল...’
- ‘ইসলাম হৃদয় জয় করার জন্য এসেছে, শাস্তি দেয়ার জন্য না...’
- ‘কথার জবাবে চাপাতি কেন? ছবির জবাবে ছুরি কেন? তুলির জবাবে বুলেট কেন?’
.
.
দুই ইস্যুতে এই ধরণের কথাবার্তা বলা লোকের মধ্যে একটা ভালো রকমের ওভারল্যাপ আছে। আর এর পেছনে শক্ত কিছু কারণও আছে। একটা কারণ হল এধরণের কথাবার্তা বলা মানূষদের বড় একটা মানুষ ‘ডু ইট ইওরসেলফ থিওলজি’-তে বিশ্বাসী। আল্লাহ কী বলেছেন, রাসূল ﷺ কী বলেছেন, সাহাবারা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) কীভাবে বুঝেছেন, উম্মাহর ইমামগণ কীভাবে বুঝেছেন – সব বাদ। ‘আমি কী বুঝেছি’, ‘আমার কী মনে হয়’, তাই গুরুত্বপূর্ণ। এদের কাছে আকিদাহর চেয়ে ‘ফিলিং’ বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
.
দ্বিতীয় কারণ হল এধরণের অবস্থান নেয়া মানুষ ইসলামের জায়গা থেকে চিন্তা করে না। লিবারেল-সেক্যুলার প্যারাডাইমের ভেতরে চিন্তা করে। এটা যে সবাই বুঝেশুনে করে তা না। বরং আমাদের অজান্তেই আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতার অন্তর্নিহিত চিন্তাগুলো আমাদের প্রভাবিত করে। এই প্যারাডাইম, এই ভাবে জীবনকে দেখা, জীবনকে ব্যাখ্যা করার প্রবণতা আমাদের চারপাশে থাকা বাতাসের মতোই ভেসে বেড়ায়। আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাসের সাথে সাথে, আমাদের যাপিতজীবনের সাথে সাথে আমরা আধুনিক সভ্যতার বস্তুবাদী ধ্যানধারণাগুলো শুষে নিয়েছি।
.
কিন্তু এগুলো ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। ইসলাম আর লিবারেল-সেক্যুলার অবস্থান এমন দুটো বিষয় যার মধ্যে সমন্বয় সম্ভব না। পূজা কিংবা অবমাননাকারীর মতো বিষয়গুলোতে এসে দুই প্যারাডাইমের মধ্যেকার সংঘর্ষ পরিষ্কার বোঝা যায়।

.
আল্লাহ বলে দিয়েছেন শিরক সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ। আল্লাহ হলেন আর-রাহমানুর রাহীম, গাফুরুর রাহীম, তিনি ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। আল্লাহর অনুগ্রহ তাঁর ক্রোধের উপর প্রবল। কিন্তু সব গুনাহ ক্ষমা করলেও তিনি শিরক ক্ষমা করবেন না। মুশরিকের জন্য ক্ষমা নেই, আছে অনন্ত কালের শাস্তি। এটা তিনি জানিয়ে দিয়েছেন। এখানে আর কারো কিছু বলার সুযোগ নেই।
.
কিন্তু আমাদের সমাজে বিশাল সংখ্যক মানুষ ব্যাপারটা এভাবে দেখে না, দেখতে পারে না। তাদের কাছে খুন, ধর্ষন, “রিলেশানশিপে চিট করা” কিংবা রেইসিস্ট হওয়া অনেক বড় অপরাধ। কারণ এই ধরণের অপরাধের সাথে মানুষের ক্ষতি যুক্ত। অন্যদিকে শিরকের কারণে কোন মানুষের, কোন বস্তুগত স্বার্থের ক্ষতি এখানে দেখা যাচ্ছে না। তাই এটা তাদের কাছে তেমন গুরুতর কোন অপরাধ না। ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’ নষ্ট করাও বরং অনেকের কাছে শিরক করার চেয়ে বড় অপরাধ।
.
একইভাবে নবী ﷺ-এর অবমাননা করা (লক্ষ্য করুন নিছক প্রত্যাখ্যান বা অস্বীকার করা না, সক্রিয়ভাবে অবমাননা করা) অত্যন্ত জঘন্য একটা গুনাহ। এটা একটা স্পেশাল পর্যায়ের অপরাধ যেখানে এসে অনেক সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম চলে আসে। এটা সুপ্রতিষ্ঠিত একটা বিষয়। মক্কা বিজয়ের দিন যেমন সবাই গণহারে ক্ষমা পেয়েছে। কিন্তু অবমাননাকারীকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। কাবার গিলাফ আকড়ে ধরেও সে বাঁচতে পারেনি।
.
কিন্তু আমাদের সমাজের বিশাল একটা অংশ মনে করে অবমাননার অপরাধের চেয়ে অবমাননাকারীকে হত্যা করা গুরুতর অপরাধ! লিবারেল-সেক্যুলার প্যারাডাইমে সবচেয়ে পবিত্র হল ব্যক্তি, ইন্ডিভিযুয়াল। ব্যক্তিকে হত্যা করা সবচেয়ে বড় গুনাহ। ক্ষমার অযোগ্য কাজ। এমন কাজ যার কোন বৈধতা দেয়া যায় না।
.
অন্যদিকে ইসলামের নবী ﷺ-এর অবমাননাকারীকে হত্যা করা আবশ্যক এবং প্রশংসনীয়। কাজটা স্বতন্ত্রভাবে অপরাধ না। যারা অপরাধ বলেছেন, তাঁরা ইসলামী শাসকের কাজ নিজের হাতে তুলে নেয়াকে অপরাধ বলেছেন। কিন্তু যে লিবারেল-সেক্যুলার প্যারাডাইম থেকে বের হতে পারেনি, সে কখনো এটা মেনে নিতে পারবে না। সে নিজেকে মুসলিম দাবি করলেও পারবে না। সে চিন্তা করবে -
> মতপ্রকাশের কারণে মানুষ হত্যা সর্বাবস্থায় মহাপাপ।
> কোন মহাপাপ ইসলামে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। অতএব,
>অবমাননাকারীকে হত্যা করা অপরাধ।
.
তার উপসংহার এবং উপসংহারের পেছনের মূলনীতিগুলোর ভিত্তি ইসলাম না, লিবারেল-সেক্যুলার প্যারাডাইম। এবং এমন মানুষের সংখ্যা কম না। এরা সেই মিথিকাল ৯০% শতাংশের অংশ যাদের নিয়ে আমাদের বক্তারা নানান জায়গায় গর্ব করেন।
.
পূজামণ্ডপ কিংবা অবমাননার মতো ইস্যুগুলোতে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য, লেখালেখি, যুক্তিখন্ডন (পলেমিক্স) –দরকার। কিন্তু এটা হল রোগের উপসর্গের চিকিৎসা করা। আমরা যদি শুধু উপসর্গের চিকিৎসায় মনোযোগী হই তাহলে সময়ের সাথে সাথে রোগ বাড়বে। সমস্যার সমাধান করতে হলে মূল রোগ সনাক্ত করতে হবে এবং সঠিক ট্রিটেমেন্ট দিতে হবে।
.
দুই প্যারাডাইমের মধ্যেকার সংঘর্ষকে স্পষ্টভাবে মানুষের সামনে তুলে ধরা, এবং মিথিকাল ‘৯০% মুসলিমের’ সামনে লিবারেল-সেক্যুলার প্যারাডাইমের গ্রহণযোগ্যতা ধ্বংস করা হল মূল রোগ সনাক্তকরণ। আর সমাধান হিসেবে ইসলামকে তুলে ধরা, ইসলামের অবস্থান থেকে ভাবতে শেখা এবং শেখানো – হল মূল ট্রিটমেন্ট। মুসলিমদের তিন অক্ষেই মনযোগ দেয়া জরুরী।
- Asif Adnan
Next Post Previous Post