আমল করেও যারা ক্ষতিগ্রস্ত - সঠিক ভাবে ইবাদত করা শিখার গুরুত্ব

যারা নামায পড়ে না, রোযা রাখে না, ইসলামের হালাল-হারাম বিধানের কোন ধার ধারে না, এক কথায় যারা কোন নেক আমল করে না, তারা যে ক্ষতিগ্রস্থ এটা সকলেই জানে, বুঝে এবং মানে। কিন্তু মানুষ যে শুধুমাত্র আমল না করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, বিষয়টি এমন নয়। বরং এমন অনেক মানুষ হবে, যারা দুনিয়ার জীবনে অনেক আমল করেও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।


মহান আল্লাহ বলেন,
تَصۡلَىٰ نَارًا حَامِيَةٗ ٤ عَامِلَةٞ نَّاصِبَةٞ ٣ وُجُوهٞ يَوۡمَئِذٍ خَٰشِعَةٌ ٢
“সেদিন অনেক চেহারা হবে অবনত, (তারা এমন মানুষ যে) আমল করে ক্লান্ত; পরিশ্রান্ত। অথচ তারা জ্বলন্ত অগ্নিতে (অর্থাৎ জাহান্নামে) প্রবেশ করবে।”
- সুরা আল-গাশিয়াহঃ ২-৪।

 শিরক, বিদআত রিয়া আমল নষ্ট করে আখিরাতের জীবন ধ্বংস করে


অর্থাৎ দুনিয়ার জীবনে এমন অনেক মানুষ হবে, যারা নেক আমল করছে কিন্তু এই নেক আমল আখিরাতে তাদের কোন উপকারে আসবে না। হয়তোবা ভুল বিদআ’তী পদ্ধতিতে আমল করেছে, বা এমন কোন পাপে লিপ্ত হয়েছে যে কারণে আমল বাতিল হয়ে গেছে। এমনই কিছু কারণ উল্লেখ করা হলো, যার কারণে মানুষের আমল নষ্ট হয়ে যায়। আল্লাহ আমাদের সবার নেক আমলসমূহ হেফাযত করুন।

(১) শিরক বা আল্লাহর সাথে শরীক করাঃ

যেই কাজ করলে আমল বা ইবাদত নষ্ট হয় তার মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে শিরক। শিরক করলে শুধুমাত্র ঐ আমল নয়, বরং অতীতের সমস্ত আমল বাতিল হয়ে যায়। কেননা, শিরক এমন একটি গুনাহ, যা বান্দার ঈমানকে নষ্ট করে তাকে কাফের বানিয়ে দেয়। একারণে শিরক করলে সমস্ত আমল নষ্ট হয়ে যায়। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাযত করুন।
মহান আল্লাহ বলেন,
وَ لَقَدۡ اُوۡحِیَ اِلَیۡکَ وَ اِلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکَ ۚ لَئِنۡ اَشۡرَکۡتَ لَیَحۡبَطَنَّ عَمَلُکَ وَ لَتَکُوۡنَنَّ مِنَ الۡخٰسِرِیۡنَ ﴿۶۵﴾
“(হে নবী!) নিশ্চয়ই আপনার প্রতি ও আপনার পূর্ববর্তী (সমস্ত নবী ও রাসুলদের) প্রতি ওহী করা হয়েছে যে, যদি আপনি শিরক করেন তাহলে আপনার সমস্ত আমল তো বাতিল হবে এবং আপনি অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের অন্তর্ভুক্ত হবেন।” সুরা যুমারঃ ৬৫।
আপনারা শিরক থেকে বাঁচার জন্য ইমাম মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওহহাব রহি’মাহুল্লাহ রচিত “কিতাবুত তাওহীদ” বইটা খুব ভালো করে পড়ুন, বারবার রিভিশান দিন, এই বই পড়ে নিজে শিরক থেকে বাঁচার চেষ্টা করুন মানুষকেও সতর্ক করুন।
আমল করেও যারা ক্ষতিগ্রস্ত


(২) রিয়া বা লোক দেখানো আমলঃ

যেই আমল সম্পাদনের সময় রিযা যুক্ত থাকে সেই আমল বাতিল হয়ে যায়। কেননা রিয়ার দ্বারা সে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো প্রশংসা বা সুনাম কামনা করে। আমলের উদ্দেশ্যে এমন শিরক যুক্ত হওয়ার কারণে সেই আমল বাতিল হয়। তবে রিয়ামুক্ত তার অন্য আমল ঠিক থাকবে। কেননা, রিয়া একপ্রকার শিরক; কিন্তু এটা ছোট শিরক। রিয়াকারীর রিয়াযুক্ত আমল বাতিল হয়, কিন্তু রিয়া “ছোট শিরক” হওয়ার কারণে তার ঈমান অঅক্ষুণ্ণ থাকে। ঈমান থাকার কারণে রিয়াকারীর রিয়ামুক্ত বাকী আমলসমূহ কবুল হয়।
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আ’নহু থেকে ‘মারফু’ হাদীসে বর্ণিত। আল্লাহ তাআ’লা বলেন, “আমি অংশীদারদের শিরক (অর্থাৎ অংশিদারিত্ব) থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। যে ব্যক্তি কোন কাজ করে ঐ কাজে আমার সাথে অন্য কাউকে শরিক করে, আমি (ঐ) ব্যক্তিকে এবং শিরককে প্রত্যাখ্যান করি।’’ সহীহ মুসলিম।


(৩) উপকার করে খোঁটা দেওয়াঃ

খোঁটা দেওয়া কথাটির অর্থ হচ্ছে, কারো প্রতি অনুগ্রহ বা দয়া করে পরবর্তীতে সেই অনুগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাকে কষ্ট দেওয়া বা লোকদের সামনে অহংকার প্রদর্শন করা। কাউকে দান করে কিংবা উপকার করে তাকে খোঁটা দিয়ে কথা বলা একটা মারাত্মক কবীরাহ গুনাহ এবং একারণে তার সেই নেক আমল বাতিল হবে, যার কারণে সে অহংকারস্বরূপ খোঁটা দিয়েছে।
আল্লাহ তাআ’লা বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تُبۡطِلُواْ صَدَقَٰتِكُم بِٱلۡمَنِّ وَٱلۡأَذَىٰ ٢٦٤﴾
“হে মুমিনগণ, তোমরা খোঁটা ও কষ্ট দেওয়ার মাধ্যমে তোমাদের সদকা বাতিল করো না।” সুরা আল-বাক্বারাহঃ ২৬৪।
আবু যর রাদিয়াল্লাহু আ’নহু থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“কিয়ামতের দিন আল্লাহ তিন ব্যক্তির সাথে কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেন না এবং তাদেরকে পবিত্রও করবেন না, বরং তাদের জন্য থাকবে কঠিন শাস্তি।” আবু যর বললেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কথাগুলো তিনবার বললেন। আবু যর বললেন, “হে আল্লাহর রাসুল! তারা ধ্বংস হয়েছে, তারা কে?” তিনি বললেন, “টাখনুর নীচে কাপড় পরিধানকারী ব্যক্তি, খোঁটা দানকারী এবং মিথ্যা কসম করে সম্পদ বিক্রয়কারী।” সহীহ মুসলিমঃ ১০৬।

(৪) বান্দার হক্ক নষ্ট করাঃ

কারো উপর যুলুম করা, অন্যের সম্পদ আত্মসাত করা বা এমন অন্য কোন উপায়ে বান্দার হক্ক নষ্ট করার কারণে ক্বিয়ামতের দিন তার পাওনা পরিশোধ করতে হবে। আর ক্বিয়ামতের দিন পাওনা পরিশোধের জন্য কোন দিনার বা দিরহাম থাকবে না, নেক আমলের সওয়াব দিয়ে পাওনা পরিশোধ করতে হবে। নেক আমল না থাকলে শেষ পাওনাদারের পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে জাহান্নামে যেতে হবে।


(৫) অন্যের নামে গীবত করা বা মিথ্যা অপবাদ দেওয়াঃ

মানুষ কত সহজেই মিথ্যা অনুমান কিংবা অর্ধেক জানার উপরে ভর করে অন্যের নাম গীবত করে কিংবা কারো সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদ দেয়। অবসর সময়ে বন্ধুদের সাথে গল্পের ফাকে একটু অসতর্ক হয়ে গীবত করে কিংবা মিথ্যা অপবাদ দিয়ে মানুষ নিজেকে জাহান্নামের কত নীচে নিয়ে যাচ্ছে, এই কথা কয়জনে চিন্তা করে? গীবত ও মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার ভয়াবহ পরিণাম হচ্ছে, যার নামে গীবত করেছে বা মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে তার পাওনা পরিশোধ করার জন্য ক্বিয়ামতের দিন নেক আমলের সওয়াব তাকে দিতে হবে। কেননা, সেইদিন কোন টাকা-পয়সা থাকবেনা পাওনা আদায় করার জন্য।
প্রকৃত নিঃস্ব ব্যক্তি কে?

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আ’নহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তোমরা কি জান, প্রকৃতপক্ষে নিঃস্ব কে?” তাঁরা (উপস্থিত সাহাবারা) বললেন, “আমাদের মধ্যে নিঃস্ব ঐ ব্যক্তি, যার কাছে কোন দিরহাম (টাকা-পয়সা) এবং কোন আসবাব-পত্র নেই।” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “আমার উম্মতের মধ্যে (আসল) নিঃস্ব তো হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে কিয়ামতের দিন অনেক নামায, রোযা ও যাকাতের (নেকী) নিয়ে হাজির হবে। কিন্তু এর সাথে সে এমন অবস্থায় আসবে যে, সে কাউকে গালি দিয়েছে। কারো প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছে, কারো মাল (অবৈধভাবে) ভক্ষণ করেছে। কারো রক্তপাত করেছে এবং কাউকে মেরেছে। অতঃপর অমুক (অত্যাচারিত) ব্যক্তিকে তার নেকী দেওয়া হবে, অমুক (অত্যাচারিত) ব্যক্তিকে তার নেকী দেওয়া হবে। পরিশেষে যদি তার নেকীগুলো অন্যান্যদের দাবী পূরণ করার পূর্বেই শেষ হয়ে যায়, তাহলে তাদের পাপগুলো নিয়ে তার উপর চাপানো হবে। অতঃপর (অন্যদের পাপের বোঝার কারণে) তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।” সহীহ মুসলিমঃ ২৫৮১, তিরমিযীঃ ২৪১৮, মুসনাদে আহমাদঃ ৭৯৬৯।

(৬) বিদআ’তঃ

বিদআ’ত দেখতে যতই সুন্দর হোক না কেনো, বিদআ’ত করলে সেই আমল বাতিল হয়।
উদাহরণঃ মিলাদ মাহফিল নাম দিয়ে সেখানে যতই দুরুদ পড়ুক না কেনো, সেই দুরুদ পড়া, সেখানে টাকা দিয়ে মিষ্টি বিতরণ করার কোন সওয়াব পাবেনা। অনুরূপভাবে, চল্লিশা, কুলখানি, মেজবানি নামে মৃত ব্যক্তিকে কেন্দ্র করা নির্দিষ্ট দিনে খাওয়ানোর কোন সওয়াব পাবেনা। মৃত ব্যক্তির পাশে বা কবরে বসে ক্বুরআন পাঠের কোন সওয়াব পাবেনা। যদিও শুধুমাত্র দুরুদ পড়া, মানুষকে খাওয়ানো, ক্বুরআন পাঠের অনেক সওয়াব রয়েছে। কিন্তু এমন অনুষ্ঠান করে বিদআ’তী পদ্ধতিতে আমল করার কারণে সেই নেক আমলের সওয়াব বাতিল হবে। শুধু তাইনা, বিদআ’ত করার কারণে এমন আমলকারীর অতিরিক্ত গুনাহ হবে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর খুতবার শুরুতে ক্বুরআনের কয়েকটি নির্দিষ্ট আয়াত এবং আরও কিছু কথা বলে সাহাবাদেরকে সতর্ক করতেন, যার মধ্যে এই কথাগুলো রয়েছেঃ

“আর তোমরা বিদআ’তের অনুসরণ ও অনুকরণ করা হতে সাবধান থাকো। কেননা, প্রত্যেক নতুন কাজ হচ্ছে বিদআ’ত, প্রত্যেক বিদআ’তই হচ্ছে গোমরাহী। আর প্রত্যেক গোমরাহীর ঠিকানা হচ্ছে জাহান্নাম।”

এছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া আরও বলেছেন, “যে ব্যক্তি আমাদের দ্বীনের মধ্যে এমন কোন নতুন বিষয় সংযুক্ত করবে যা তার অংশ নয়, তা প্রত্যাখ্যাত হবে (অর্থাৎ তা গ্রহণযোগ্য হবে না)।” সহীহ বুখারীঃ ২৬৯৭, সহীহ মুসলিমঃ ১৭১৮।


(৭) জ্ঞান অর্জন না করে অজ্ঞ মূর্খ থেকে ভুল পদ্ধতিতে আমল করাঃ

জ্ঞান অর্জন করা ফরয। কোন আমল করার পূর্বে সেই আমল কিভাবে করতে হয় সেটা শিখে নেওয়া ফরয। কিন্তু কেউ যদি জ্ঞান অর্জন করার ফরয তরক করে নিজের মনগড়া আমল করে আর সেই আমলে ফরয ওয়াজিব ছুটে যায় তাহলে তার সেই আমল বাতিল হবে।
উদাহরণঃ মহিলাদের পর্দা করা ফরয। পর্দা বলতে কি বুঝায়, এই ব্যাপারে শরীয়তে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু কোন মহিলা যদি পর্দা না শিখে লোকদের দেখাদেখি মাথায় স্কার্ফ পড়ে শুধুমা চুল ঢেকে মনে করে, আমিতো পর্দা করছি - তার এই আমল বাতিল। কেননা, সে নিজের মনগড়া পর্দা করছে, যেই পর্দা দ্বারা শরীয়তের পর্দার শর্ত পূরণ হচ্ছেনা। অনুরূপভাবে, পুরুষদের দাঁড়ি রাখা ফরয। কিন্তু কোন পুরুষ যদি ফ্যাশানের উদ্দেশ্যে হালকা দাঁড়ি রাখে এটা দ্বারা তার ফরয আদায় হবেনা। কেননা, দাঁড়ি রাখা মানে লম্বা রাখা।
এই জন্য যে কোন কথা ও কাজের পূর্বে, সে সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা ফরয।
আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “(দ্বীনের) জ্ঞান অর্জন করা করা প্রত্যেক মুসলমান (নারী ও পুরুষের) জন্য ফরয।” ইবনু মাজাহঃ ২২৪, হাদীসটি হাসান।

©সিরাতল মুস্তাকিম
Next Post Previous Post