পবিত্র কাবা ঘরের কালো গিলাফ দেখা : মসজিদে হারামের ছবি

 কালো গিলাফের দর্শন : Abdullah Al Masud

মসজিদে হারামের চত্তরে যখন পা দিচ্ছি তখন আসরের জামাত শুরু হবে হবে অবস্থা। প্রশস্ত চত্তরটা মর্মর পাথর মোড়ানো। প্রচণ্ড রৌদ্রের নিচেও নিজেকে শীতল রেখে বাইতুল্লাহর মেহমানদের সেবা দেয়। কদম কদম পা ফেলে কিং ফাহাদ গেটের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম। আম্মুর হাতটা শক্ত করে আমার হাতে ধরা। কখন আবার হারিয়ে যান সেই আশঙ্কা থেকেই চোখের আড়াল হতে দিচ্ছি না তাকে।

দৃষ্টিনন্দন এই গেট ছবিতে বহুবার দেখলেও বাস্তবে এই প্রথম দেখা। কী দারুন আর কারুকার্যময়! আয়াতের ক্যালিগ্রাফি এর সৌন্দর্যের মাত্রাকে আরো বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ভেতরে আসরের সালাতের অপেক্ষায় লোকজন। একটু সামনে বাড়তেই ইকামত শুরু হলো। কি করব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কারণ পুরুষদের সাথে মহিলাদের সালাতে দাড়ানোর নিয়ম নেই। তাদের কাতার আলাদা। একে তো আমি নতুন এসেছি, তার উপর সাথী-সঙ্গীদের হারিয়ে ফেলেছি। তাই কিছুটা দিশেহারা বোধ করছিলাম। উনাকে হাতছাড়া করা মানেই বিপদের দরজা খুলে দেওয়া। কারণ তাঁর সাথে মোবাইল থাকলেও সিম কিনতে পারিনি বিধায় সেটা অকার্যকর হয়ে আছে। শেষমেশ কিছুটা দূরে মহিলাদের কাতারের একপাশে ঝটপট উনাকে দাঁড় করিয়ে দিলাম। যাবার আগে বললাম নামাজ শেষে ঠিক ওখানেই থাকতে।

দুলছুট হয়ে মনে হচ্ছে আকূল পাথারে এসে পড়েছি। মসজিদে হারামের প্রথম দর্শন এমন বিব্রতকর হবে কে জানত! হয়ত এর ভেতরে কল্যাণ আছে। এটা ভেবে মনকে প্রবোধ দিলাম। কাছাকাছি দূরত্বে আমিও সালাতে দাড়ালাম। এখান থেকে আম্মুকে দেখা যায়। সুতরাং হারানোর ভয় নেই। এই পুরো সময়ে চোখ তুলে তাকাইনি উপরের দিকে। মাথা নিচু রেখে হেঁটেছি। আজন্ম লালিত স্বপ্ন কাবার দর্শন হুট করে চোখে পড়ে সাদামাটা হোক তা চাচ্ছিলাম না। তাছাড়া কাবার প্রথম দর্শন দুআ কবুলেরও মুহূর্ত। সুতরাং এই সুযোগ হাতছাড়া করার কোন মানে হয় না।


আসরের সালাতে উচ্চস্বরে কিরাআত না থাকলেও তাকবিরের ধ্বনি শুনেই বুঝেছি উনি বান্দার বাললীহ। প্রযুক্তির কল্যাণে তাঁর সুললিত কণ্ঠের মধুমাখা তিলাওয়াতের সাথে পূর্বপরিচয় ছিল। সুদর্শন এক ইমাম। চেহারা যেমন, কণ্ঠও তেমন। মসজিদে হারামের উন্নত সাউন্ডবক্স থেকে ইমামের দরাজ গলায় দ্বিতীয় সালাম ফিরানোর আওয়াজ শেষ হওয়ার পরপরই মনে হলো গোল গোল অনেকগুলো তাসবিহ থেকে দানাগুলো খুলে পড়ে এদিকসেদিক এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। গোলাকৃতির কাতারগুলো থেকে লোকজন এদিক-ওদিক ছুটতে লাগল। আমি দ্রুত গিয়ে আম্মুর হাত ধরলাম। এবার পালা কাঙ্খিত সেই মুহূর্তের। আম্মুকেও বলে রেখেছিলাম কাবার দিকে আগেভাগে না তাকাতে। দৃষ্টিকে নিচু করে রাখতে।

একটু সময় অপেক্ষা করতেই ভীড় কমে এলো। লোকজনকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলাম সামনের দিকে। দুই ধাপে কিছু সিঁড়ি ভেঙ্গে নামতে হবে কাবা চত্তরে। আমরা যেখানে নামাজ পড়েছি সেটা কিছুটা উঁচুতে। মর্মর পাথরের সিঁড়ি ভেঙ্গে এক পা দুই পা করে দুরুদুরু বুকে নামতে লাগলাম নিচের দিকে। মনে হচ্ছিল কোন স্বপ্নের জগতের বাসিন্দা আমি। স্বপ্নলোকে বেড়াতে এসেছি কোন স্বর্গীয় উদ্যানে। চারপাশ জুড়ে শুভ্রসফেদ ফেরেশতাদের আনাগোনা। অদূর থেকে মৃদস্বরে ভেসে আসছে আরেকদল ফেরেশতার তালবিয়া-ধ্বনি- লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারীকা লাকা লাব্বাই, ইন্নাল হামদা ওয়ান নি'মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারীকা লাক।

সর্বশেষ সিঁড়িতে পা রেখে একপাশে খালি জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। আম্মুকে বললাম এবার চোখ তোলেন আর প্রাণভরে দেখেন পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর কাবা। হাত তুলে দুআও করেন। কারণ এই সময় দুআ কবুল হয়।

আমি নিজেও একটু একটু করে মাথা তুললাম। তারপর ধীরগতিতে চোখ মেলে তাকালাম সামনের দিকে। ঠিক যেভাবে মজাদার কোন আচার-চাটনি একটু একটু করে খাই। একসাথে খেয়ে ফেললে যদি স্বাদের জিনিসটা শেষ হয়ে যায়! স্বপ্ন পুরনের লগ্ন যখন উপস্থিত, তখন আবেগের সমুদ্রে পূর্ণ জোয়ার বইবে এটাই তো স্বাভাবিক। আমি ছিলাম বাকরুদ্ধ। দু'হাত তুলে অনেকক্ষণ নিশ্চুপ রইলাম। কী রেখে কী বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। মনের মধ্যে হাজারো অনুভূতি আর প্রার্থনার ঢেউ তখন আছড়ে পড়ছে। আমার মহান রব্বের কাছে মুখ ফুটে বলতে হয় না। তিনি অন্তর্যামী। মনের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র ভাবনাও তার গোচরাধীন। এরপর স্বাভাবিক হয়ে কিছু দুআ করে সামনে বাড়লাম।

কালো গিলাফের যত কাছাকাছি হচ্ছিলাম ততোই মুগ্ধতা বেড়ে যাচ্ছিল। কালোও বুঝি এত সুন্দর হয়! সারাজীবন কালোকে কুৎসিতের রূপ শুনে এসেছি। এখন দেখি পুরোই উল্টো। এই সৌন্দর্য যেন চোখ ঝলসে দিয়ে হৃদয়-মনকে একেবারে বিগলিত করে দিবে। উচ্চতায় দোতলা সমান কালো গিলাফে ঢাকা ঘরটিকে কেন্দ্র করে ঘুরছে একদল শুভ্রসফেদ মানুষের ঝাঁক। মুখে তাকবির আর তালবিয়া ধ্বনি। চারদিক মুখরিত দুআ আর যিকিরে। আম্মুর হাত ধরে আমি সবুজ বাতির কাছাকাছি যাবার জন্য হাঁটা শুরু করলাম। ওখান থেকেই শুরু করতে হবে উমরার তাওয়াফ।
Next Post Previous Post