শহীদ ইলমুদ্দিন : ইতিহাসের হিরো

 শহীদ ইলমুদ্দিন

.
ঠিক ৯২ বছর পূর্বে ১৯২৯ সালের এইদিনে (৩১ অক্টোবর) তারিখে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায় একটা ফাঁসির আদেশ বাস্তবায়িত হয়। এক ছুতার মিস্ত্রির ১৯ বছর বয়সী অশিক্ষিত কৃষক ছেলের ফাঁসি। ঐ ফাঁসি ও পূর্বাপর ঘটনা ছিল উপমহাদেশের ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত ও বিক্ষোভময়।
.
১৯২০ সালে ‘রঙ্গিলা রাসুল’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। এখানে ‘রঙ্গিলা’ অর্থ ছিল ‘প্রমোদবালক’ বা ‘প্লে বয়’। বইটার লেখক- প্রসাদ প্রতাপ, লিখেছিলেন ছদ্মনাম ‘চামুপতি পণ্ডিত’ নামে। রাজপাল নামে লাহোরের এক ব্যবসায়ী ১৯২৩ সালে বইটা প্রকাশ করেন, লেখকের প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ না করে।
.
বইটি নিয়ে বিক্ষোভ চরমে পৌঁছায়। লাহোর সেশন কোর্টে মুসলিম আইনজীবীরা মামলা করেন। রাজপাল’কে দাঙ্গা বাঁধানোর প্রচেষ্টায় দোষী সাব্যস্ত করে সাজা দেয় সেশন কোর্ট। রাজপাল সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। আপিল আদালতে এর শুনানি করেন বিচারপতি দিলীপ সিং। দিলীপ সিং অদ্ভুত এক রায়ে তাকে মুক্তি দেয়।
.
রাজপাল মুক্তি পান। এই মুক্তির ঘটনা লাহোর থেকে ঢাকা সর্বত্রই মুসলিমদের কাছে ঘৃণ্য বলে পরিগণিত হয়। বিক্ষোভ, মিছিল, সিরাত সম্মেলন চলতে থাকে। বিচার ব্যবস্থায় যেহেতু কোনো সমাধান হয়নি, মানুষের মাঝে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। অশিক্ষিত চাষা যুবক ইলমুদ্দিন আবেগমথিত হয়ে পড়েন।
.
১৯২৯ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ইলমুদ্দিন এক রুপি দিয়ে বাজার থেকে একটা খঞ্জর কিনে রাজপালের বইয়ের দোকানে অপেক্ষা করতে থাকেন। তিনি রাজপালকে চিনতেন না। দিনভর দাঁড়িয়ে থেকে লোকেদের জিজ্ঞেস করে তিনি রাজপালকে চিনে নেন। সোজা গিয়ে তার বুক বরাবর ছুরিটি ঢুকিয়ে দেন।
.
ছুরি রাজপালের হৃদপিন্ড বিদ্ধ করে। রাজপাল মারা যায়। ইলমুদ্দিন একটুও পালাননি, ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। আল্লামা ইকবাল, ব্যারিস্টার মইন উদ্দিন খানসহ অসংখ্য মুসলিম তাঁর পক্ষে মাঠে নামেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর ডিফেন্স লইয়ার হিসেবে মামলা হাতে নেন।
.
জিন্নাহ তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, “আদালতকে বোলো- এ কাজ করার সময় আমি মানসিক স্থিরতাসম্পন্ন ছিলাম না”। ইলমুদ্দিন তা অস্বীকার করেন। সেশন কোর্টে তাঁর ফাঁসির আদেশ হয়- উচ্চ আদালতেও তা বহাল থাকে। জিন্নাহ পূর্বে কোনো কেস হারেননি। এই কেস “জিন্নাহ'স অনলি লস্ট কেস” নামে পরিচিত।
.
শেষ ইচ্ছে হিসেবে ইলমুদ্দিন তিনি দু’রাকাত সালাত আদায়ের সুযোগ চেয়েছিলেন। তারপর ব্রিটিশ সরকার তাঁকে জানাজা ছাড়াই দাফন করে। আল্লামা ইকবাল, মইন আব্দুল আজীজ প্রমুখ মুসলিম নেতারা প্রবল বিক্ষোভ করেন। অবস্থা অবনতির দিকে গেলে ব্রিটশ সরকার লাশ উত্তোলনের অনুমতি দেয়।
.
১৫ দিন পর ১৪ নভেম্বর লাশ উত্তোলন করা হয়- অথচ বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল তাঁর দেহ না পঁচন ধরেছিল, না দুর্গন্ধ ছিল, না তাঁর কাপড়েও কোনও পরিবর্তন ঘটেছিল। দুই দিন পরে লাশ লাহোর পৌঁছায়। পথে লাখ লাখ লোক তাকে শ্রদ্ধা জানায়। লাহোরে দুই লক্ষ লোকের উপস্থিতিতে জানাজা হয়।
.
তাঁকে প্রথমে গাজী এবং মৃত্যুর পর শহীদ উপাধি দেওয়া হয়। ইলমুদ্দিনের বাবা আল্লামা ইকবালকে জানাজা পড়ানোর অনুরোধ করলে তিনি জবাব দেন, “আমার মত গোনাহগার গাজী ইলমুদ্দিন শহীদের জানাজা পড়ানোর যোগ্য নয়”। তাঁর জানাজা পড়ান মসজিদ ওয়াজির আলি খানের ইমাম মাওলানা জাফর আলি খান।
.
পাকিস্তান জুড়ে অসংখ্য স্থাপনা, পার্ক, রাস্তা, হাসপাতাল, প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে তাঁর নামে। তাঁর মাজার জিয়ারত লাহোরজুড়ে এখনো অন্যতম আকর্ষণ। আল্লামা ইকবালসহ অসংখ্য কবি তাঁকে নিয়ে কবিতা লিখেন। পুস্তকও লেখা হয়েছে তাঁকে নিয়ে। এই ঘটনার পরের বছরই ইকবাল ‘পাকিস্তান’ রাষ্ট্রতত্ত্ব দেন।
.
ইলমুদ্দিনের ফাঁসির মাধ্যমে শুরু হওয়া ঘটনাপ্রবাহ জোরদার হতে থাকে। পৃথক আবাসভূমির দাবি চূড়ান্ত হতে থাকে। জীবিত ইলমুদ্দিনের চেয়ে শহীদ ইলমুদ্দিন রাজনীতিতে পাকিস্তানের অন্যতম প্রভাবশালী স্বত্ত্বা হিসেবে দেখা দেন। পাকিস্তানের পেনাল কোডের সেকশন ২৯৫ তৈরি হয় তাঁর ঘটনা সামনে রেখে।
.
সেদিন যদি ঐ অপকর্মের জন্য বইটির জন্য প্রতাপ প্রসাদ বা রাজপাল শাস্তি পেত, তবে হয়ত এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হত না। অপরাধের শাস্তি না হওয়াই ছিল এ ধরনের ঘটনা সৃষ্টির মূল প্রেক্ষাপট। এসকল ইতিহাস চেপে রাখা হলেও মানুষের আবেগ-আকাঙ্ক্ষা এখনও অপরিবর্তিতই রয়েছে।
.
✍ Mohammad Salimullah 










Next Post Previous Post