ভিপি নূর vs ইসলামিস্টদের জনমানুষের মনস্তত্বে বাস্তবিক আবেদন প্রসঙ্গে-

সাধারণ খেটে খাওয়া কর্মজীবী মানুষ খেয়াল করে কারা মূলত তাদের সমস্যা নিয়ে কথা বলছে, তাদের আপাত অধিকার আদায় নিয়ে সোচ্চার হচ্ছে, তাদের শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, আন্দোলন করছে।

দৈনন্দিন জীবনের মৌলিক প্রয়োজন নিয়ে যখন উঁচুতলার লুটেরারা তামাশা করে গরীবের সাথে, তখন এই গরীবেরা তত্বকথার কচকচানি চায় না, তারা চায় এইসব নির্যাতন নিপীড়ন থেকে কেউ তাদের উদ্ধার করুক, তাদের ভাষা হয়ে প্রতিবাদ জানাক, হাজারো হিসেবের মারপ্যাঁচ থেকে রক্ষা করে কেউ এসে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দিক।

আর যখন এই ক্ষেত্রে কেউ তাদের হয়ে এগিয়ে আসে, এই সাধারণেরা তাদেরকেই নিজেদের হিরো বানায়, যদিও আদর্শিকভাবে তারা যতই কাংগাল হোক, হোক না স্ববিরোধিতা বা অবাস্তবিক ইউটোপিয়াতে ভরপুর।

তাত্বিকভাবে কার আদর্শ কতখানি মজবুত, কার অতীতে কী সোনালি অধ্যায় আছে, কারো আদর্শের সত্যতার পেছনে যুক্তিতর্ক কতখানি মজবুত এইসব নিয়ে সাধারণ মানুষের কোন মাথাব্যথা নেই, থাকার কথাও না। কারণ বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে তারা সেই যোগ্যতা অর্জনের সুযোগ পায়নি, অথবা সুযোগ থাকা সত্বেও সেই পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি।




ভিপি নূরের মত লোকেরা রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় গণতন্ত্রকে আদর্শ মনে করে এবং তারা বিশ্বাস করে অন্য কোন আদর্শ নয়, গণতন্ত্র দিয়েই তারা শান্তি, শৃংখলা, জনমানুষের অধিকার, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। তারা ইসলামকে স্বয়ংসম্পূর্ণ আদর্শ মনে করেনা, এর মাধ্যমেই যে জীবনের সামগ্রিক সমস্যার সমাধান সম্ভব তা তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক এন্টেনায় ধরা পড়েনি, হতে পারে অনিচ্ছায় বা স্বেচ্ছায়।

কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো, সাধারণ, অসহায়, খেটে খাওয়া মানুষেরা এইসব আদর্শের মারপ্যাঁচ দেখেনা। তারা দেখে কে তাদের হয়ে কথা বলছে, তাদের বক্তব্যকে সঠিক আবেদন দিয়ে উপস্থাপন করছে বৃহত্তর সার্থে, সর্বস্তরের প্লাটফর্মে।

গত কয়েকবছরের যত ছাত্র আন্দোলন রয়েছে- কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন সহ জনমানুষের দৈনন্দিন জীবনের একদম বাস্তব সমস্যা নিয়ে যারা সোচ্চার হবে, কথা বলবে, মার খাবে, জেলে যাবে, তবুও লেগে থাকবে তাদেরকেই মানুষ বেশি কাছের মনে করবে, তাদের আদর্শকেই মানুষ বেশি বাস্তবিক মনে করবে, তাদের দেখানো পথেই তারা শান্তি অর্জনের চেষ্টা করবে।

এই যে ভিপি নূরেরা জনমানুষের প্রয়োজন নিয়ে এভাবে প্রতিনিয়ত কথা বলছে, ইসলামিস্টদের জায়গা থেকেও কি এমন জীবনঘনিষ্ঠ ব্যাপার নিয়ে কথা বলা, সোচ্চার হওয়া জরুরি নয়? এই যে ইসলামি বইমেলাতে গিয়ে সে এবং তার টীম দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বাস ভাড়া, পেট্রোলের দাম এইসব নিয়ে আন্দোলনে যাবার জন্য সরাসরি দাওয়াত দিচ্ছে, ইসলাম চায় এমন মানুষদের কি তাকে, তার দলকে গণতন্ত্রের অসারতা, মানব জীবনের জন্য ইসলামই কেনো একমাত্র স্বয়ংসম্পূর্ণ বাস্তবিক সমাধান এইসবের দাওয়াত দেয়া উচিত ছিল না?

কিন্তু সেই তুলনায় কতখানি এফোর্ট আমরা দিতে পেরেছি? সাধারণ মানুষের ইস্যু নিয়ে আমরা কতখানি কথা বলতে পেরেছি, সেদিকে নজর দিয়েছি? এ কথা সত্য যে, ইসলাম পুরো ব্যাপারটাকে কেবল শাখা প্রশাখার আপাত আই ওয়াশিং সমাধান চেয়ে আত্মতুষ্টিতে ভুগতে বলেনা, এই নিজাম পুরো কাঠামোর গোড়া থেকে ইসলামকে প্রতিষ্ঠার কথা বলে।
কিন্তু তার মানে তো এই না, সাধারণের সাথে সম্পৃক্ততা প্রকাশের জায়গায় এসে নিরব হয়ে যেতে হবে, প্রচলিত প্রতিবাদ, আন্দোলনের পদ্ধতি ছাড়াও কথা বলার অনেক মাধ্যম এবং পদ্ধতি রয়েছে। সেগুলোই বা আমরা কতদূর কাজে লাগাতে চেয়েছি বা পেরেছি!

একটা পরিবর্তন, বিপ্লব কখনো সাধারণ মানুষের মনস্তাত্ত্বিক সাপোর্ট ব্যতীত ফলপ্রসূ হয়না, স্থায়ীও হয়না৷ এই জনমানুষকে আমরা ইসলামের তাত্বিক আবেদন হয়তো বয়ানে বয়ানে শোনাতে পেরেছি, আমাদের নিজেদের উদাসীনতা এবং অনেক সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের সেই বাস্তবিক প্রয়োগ দেখাতে পারিনি।

ফলে তাদের জীবন ঘনিষ্ঠ ইস্যু নিয়ে সামান্য লাফঝাপ, আর আপাত শাখা প্রশাখার সমাধান দেখিয়ে হয়তো ভবিষ্যতে ভিপি নূরেরা জনমানুষের প্রতিনিধি হয়ে উঠবে। তাদের আদর্শের ফাকফোকড় দেখিয়ে, আর আমাদের সোনালী অতীত শুনিয়ে আমরা হয়তো আত্মতৃপ্তিতে ভুগবো।

কিন্তু সাধারণ মানুষ ইসলামকে সকল সমস্যার সমাধান হিসেবে বাস্তবিক প্রয়োগ না দেখতে পেয়ে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা সহ হাজারো মানবসৃষ্ট মতাদর্শের গ্যাড়াকলেই আটকে থাকবে! আফসোস! এর দায় থেকে আমরা কোনভাবেই নিজেদের মুক্ত ভাবতে পারিনা। ভেবে থাকলে সেটা কেবলই আত্মপ্রতারণা!
- Mahfuj Alamin
Next Post Previous Post